,

হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে যেভাবে ইসরায়েল খুঁজে বের করে হত্যা করেছে

দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর ইসরায়েলি বাহিনীর গোপন অভিযানে নিহত হলেন হামাসের প্রধান

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর অবশেষে গাজার দক্ষিণে বহুদিন ধরে আত্মগোপনে থাকা হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হয়েছেন। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ওপর হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। সেই হামলার পর থেকেই সিনওয়ার গাজার সুড়ঙ্গপথে লুকিয়ে ছিলেন এবং ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তার খোঁজে অভিযান চালিয়ে আসছিল। অবশেষে তাকে খুঁজে বের করে হত্যা করতে সক্ষম হয় তারা।

৬১ বছর বয়সী ইয়াহিয়া সিনওয়ার গাজার সুড়ঙ্গ ব্যবস্থার মধ্যে লুকিয়ে থাকার সময় তার সুরক্ষার জন্য কয়েকজন দেহরক্ষী এবং ধারণা করা হচ্ছিল যে ইসরায়েলি হামলায় আটক হওয়া কিছু বন্দিকে ‘মানব ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। তবে ইসরায়েলি বাহিনী তাকে যখন হত্যা করে, তখন তার সঙ্গে খুব কমসংখ্যক দেহরক্ষী ছিল এবং কোনও বন্দিও সেখানে পাওয়া যায়নি। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হামাস একটি বড় ধাক্কা খেলো এবং সংগঠনটির নেতৃত্বের কাঠামো নতুন করে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।

রাফাহতে অভিযানের সময় ধরা পড়লেন সিনওয়ার

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে, বুধবার রাফাহ অঞ্চলের তাল আল-সুলতান এলাকায় ৮২৮তম ব্রিগেডের একটি ইউনিট টহল দিচ্ছিল। সেই সময় তারা তিনজন সশস্ত্র ব্যক্তিকে দেখতে পায় এবং তাদের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। গুলিবিনিময়ের পর তিনজনই নিহত হন। শুরুতে এ সংঘর্ষটিকে বিশেষ কিছু মনে করা হয়নি এবং সৈন্যরা বৃহস্পতিবার সকালের আগ পর্যন্ত ঘটনাস্থলে ফিরে আসেনি।

পরে, নিহতদের মধ্যে একজনের মৃতদেহ পরীক্ষা করার সময় দেখা যায়, তার মুখমণ্ডল হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের সঙ্গে মিল রয়েছে। ঝুঁকি এড়াতে মৃতদেহটি সরানোর পরিবর্তে তার একটি আঙুলের অংশ কেটে ডিএনএ পরীক্ষা করার জন্য পাঠানো হয়। ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ থেকে ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল পেলে পরে নিশ্চিত হওয়া যায় যে নিহত ব্যক্তিটি আসলেই ইয়াহিয়া সিনওয়ার।

আইডিএফের মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি জানান, তার বাহিনী “জানতো না তিনি সেখানে ছিলেন, কিন্তু আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন চালিয়ে যাচ্ছিলাম।” তিনি আরও জানান, সেনারা যখন তিনজন সশস্ত্র ব্যক্তিকে বাড়ির দিকে দৌড়াতে দেখে, তখন তারা তাড়া করে এবং সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সিনওয়ার “একটি ভবনে ঢুকে পড়েছিলেন” এবং তাকে ড্রোনের মাধ্যমে চিহ্নিত করার পর তাকে সেখানেই হত্যা করা হয়। তার সঙ্গীদের কাউকে সেখানে পাওয়া যায়নি।

ইসরায়েলের সফলতার দাবির পর প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজ

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী সিনওয়ার হত্যার পর তার শেষ মুহূর্তগুলোর ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে। সেই ফুটেজে দেখা যায়, একটি ড্রোন একটি বিধ্বস্ত ভবনের দ্বিতীয় তলার জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে এবং ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটি সোফায় বসে থাকা একজন ব্যক্তিকে সনাক্ত করে। ব্যক্তিটি মুখমণ্ডল আংশিকভাবে ঢেকে রেখেছিল এবং ধূলাবালিতে আচ্ছাদিত ছিল। ড্রোনটি ঘুরে দেখতে গেলে ওই ব্যক্তি কিছু একটা ছুড়ে ড্রোনটির দিকে ছুঁড়ে মারেন, তারপর ভিডিওটি শেষ হয়ে যায়। ইসরায়েলি বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এটি সিনওয়ারের শেষ মুহূর্তগুলোর একটি ভিজ্যুয়াল রেকর্ড।

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা অনুসন্ধানের সফল সমাপ্তি

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বেশ কয়েক মাস ধরেই সিনওয়ারকে খুঁজে বের করতে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছিল। গাজায় লুকিয়ে থাকা অবস্থানগুলোতে তার অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য গোয়েন্দা তথ্য, ড্রোন এবং স্যাটেলাইট ইমেজের মাধ্যমে নজরদারি চালানো হয়। ইসরায়েলি বাহিনী সিনওয়ারকে গাজার দক্ষিণে রাফাহ এলাকায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করে এবং ধীরে ধীরে তার কাছাকাছি পৌঁছানোর প্রক্রিয়া শুরু করে।

সিনওয়ার বেশ কয়েকবার তার লুকিয়ে থাকার স্থান পরিবর্তন করেন এবং বিভিন্ন সুরক্ষা কৌশল ব্যবহার করেন, যেমন সুড়ঙ্গ ও গোপন ঘরগুলোতে লুকিয়ে থাকা। ইসরায়েলি বাহিনী তার এই গতিপথের ওপর নজর রেখে ধীরে ধীরে তার চলাফেরার ক্ষমতা সীমিত করে ফেলেছিল। অবশেষে, ইসরায়েলের ধারাবাহিক অভিযান ও গোয়েন্দা তথ্যের সফল ব্যবহারেই তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়।

হামাসের প্রতিক্রিয়া ও নতুন সংকট

ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা করা হামাসের জন্য একটি বড় আঘাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর আগে হামাসের সাবেক প্রধান ইসমাইল হানিয়া নিহত হন এবং তার পরই সিনওয়ার নেতৃত্বে আসেন। এখন তার মৃত্যুর পর সংগঠনটি একটি কঠিন পুনর্গঠনের সম্মুখীন হতে পারে। হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য বাসেম নায়েম এক বিবৃতিতে বলেন, “ইসরায়েল মনে করছে আমাদের নেতাকে হত্যা করলেই আমাদের আন্দোলন কিংবা ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রাম থেমে যাবে। তবে সেটি কখনোই সম্ভব নয়।”

সিনওয়ার হত্যার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল বড় ধরনের সামরিক ও নৈতিক সফলতা অর্জনের দাবি করলেও, হামাস এখনও তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করেছে। সংগঠনটি বলছে, সিনওয়ার একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হলেও, ফিলিস্তিনিদের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম কোনো ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়।

কাতারের দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের অধ্যাপক মোহাম্মদ এলমাসরি আল-জাজিরাকে বলেন, “সিনওয়ারকে হত্যা করা যদি সত্যি হয়, তাহলে হামাসকে একটি বড় পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। কারণ, তাদের নেতৃত্ব কাঠামো ইতোমধ্যেই ভেঙে পড়েছে।”

‘ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের’ ইসরায়েলি নীতির বিরুদ্ধে বিতর্ক

ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের অবরোধের কারণে গাজা উপত্যকায় মানবিক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। ৭ অক্টোবরের হামলার পর থেকে ইসরায়েল গাজার ত্রাণ সরবরাহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এই অবরোধের কঠোর সমালোচনা করেছে।

জাতিসংঘের ফিলিস্তিনিদের জন্য ত্রাণ ও কর্মসংস্থানবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ গাজায় একটি “বাস্তব দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি” সতর্কবার্তা দিয়েছে। সংস্থাটির প্রধান ফিলিপ্পে লাজ্জারিনি বলেন, “আমরা এমন একটি সংকটময় পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছি যেখানে দুর্ভিক্ষ ও মারাত্মক অপুষ্টি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।” একই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রও ইসরায়েলের ‘ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না’ তা নজরদারি করছে।

গাজায় বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৩৫০ ট্রাক ত্রাণ সরবরাহের প্রয়োজন থাকলেও, ইসরায়েল মাত্র ৫০ ট্রাক ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। এই সীমাবদ্ধ ত্রাণ প্রবেশের ফলে গাজার বাসিন্দারা খাদ্য, পানি এবং ঔষধ সংকটে ভুগছে।

লেবাননে উত্তেজনার মধ্য দিয়ে চলমান যুদ্ধ

ইসরায়েল ও লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর মধ্যে সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলি বাহিনী ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে এবং লেবাননের টায়রে ও বেকা অঞ্চলের বাসিন্দাদের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

হিজবুল্লাহ দাবি করেছে, গত কয়েক দিনে তারা দুটি ইসরায়েলি মারাকাভা ট্যাংক ধ্বংস করেছে। হিজবুল্লাহর মুখপাত্র জানিয়েছে, সীমান্তে মুখোমুখি সংঘর্ষের সময় গাইডেড মিসাইল দিয়ে ট্যাংকগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। এই সংঘাত আরও বাড়তে পারে এবং ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।

‘প্রতিশোধ’ ও যুদ্ধের অবসান নিয়ে বিতর্ক

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইয়াহিয়া সিনওয়ার হত্যাকে “প্রতিশোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা ৭ অক্টোবরের হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রতিশোধ নিয়েছি। কিন্তু গাজার যুদ্ধ এখানেই শেষ নয়। আমরা আমাদের প্রিয়জনদের মুক্ত করার জন্য লড়াই চালিয়ে যাবো।”

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীও এই হত্যাকাণ্ডকে একটি বড় সফলতা হিসেবে তুলে ধরছে। তাদের মতে, সিনওয়ার হত্যার মাধ্যমে হামাসের সামরিক পরিকল্পনাকে ব্যাহত করা হয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক মুখপাত্র জানিয়েছে, সিনওয়ার হত্যার পরেও গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং হামাসের হাতে আটক কমপক্ষে ১০১ জন ইসরায়েলি বন্দি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চালানো হবে।

গাজায় যুদ্ধের অবসান নিয়ে অনিশ্চয়তা

ইয়াহিয়া সিনওয়ার হত্যার পর ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়েছে। গাজার বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যতের সংকট নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ইসরায়েলের সামরিক অভিযান, হামাসের প্রতিরোধ এবং মানবিক সংকটের ফলে গাজায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনার প্রচেষ্টা ক্রমশ আরও জটিল হয়ে উঠছে।

হামাসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা নেতার মৃত্যুর পরেও তাদের প্রতিরোধের গতি বাড়াবে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখবে। ফিলিস্তিনিদের অনেকেই সিনওয়ারের মৃত্যুকে শহীদের মৃত্যু হিসেবে দেখছেন, যা নতুন করে সংঘাতের ইন্ধন জোগাতে পারে। অন্যদিকে, ইসরায়েলি নেতৃত্বও যুদ্ধের অবসান না হওয়া পর্যন্ত তাদের অভিযান চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের পাশাপাশি, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ কতটা দীর্ঘায়িত হবে এবং কিভাবে শেষ হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সিনওয়ার হত্যার মাধ্যমে ইসরায়েল হামাসের সামরিক শক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে সক্ষম হলেও, গাজায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে আরও বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।

আরও পড়তে পারেন