নির্বাচন কমিশন ও সরকারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত সংশ্লিষ্ট মহল
বাংলাদেশের ভোটারদের ব্যক্তিগত তথ্যভান্ডার বা ডেটা সেন্টার নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বর্তমানে দেশের প্রায় সোয়া ১২ কোটি ভোটারের ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে তৈরি করা এই ডেটা সেন্টারের প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হাতে নেই। বরং, বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি এবং তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইবিসিএস প্রাইমেক্স সফটওয়্যারের হাতে রয়েছে এই নিয়ন্ত্রণ।
সরকার এবং নির্বাচন কমিশন এই পরিস্থিতিতে ডেটাবেজের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ডেটা সেন্টারের মূল নিয়ন্ত্রণ যেহেতু এখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে, তাই তার নিরাপত্তা, ব্যবস্থাপনা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
নিরাপত্তা ঝুঁকি ও ডেটাবেজের উপর নিয়ন্ত্রণহীনতা
বর্তমান পরিস্থিতি এমন যে, ভোটারদের ৪৬ ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষিত এই ডেটা সেন্টারের ক্রেডেনশিয়াল, সোর্স কোড, নেটওয়ার্ক ডায়াগ্রাম এবং সিস্টেম আর্কিটেকচার—সবকিছুই টাইগার আইটির হাতে রয়েছে। টাইগার আইটির পাশাপাশি তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইবিসিএস প্রাইমেক্স সফটওয়্যারও এই প্রকল্পের অংশীদার।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, টাইগার আইটির কাছ থেকে ডেটা সেন্টারের নিয়ন্ত্রণ না পাওয়া পর্যন্ত এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ নিয়ে ইসি এবং টাইগার আইটির মধ্যে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। তবে টাইগার আইটি তাদের কিছু সফটওয়্যারের সোর্স কোড এবং অন্যান্য বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদ ‘ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টি’ হিসেবে দাবি করে তা হস্তান্তরে আপত্তি জানিয়েছে।
সরকার পতনের পর নতুন উদ্যোগ
গত ৫ই আগস্ট, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এর এক মাস পর, ৫ই সেপ্টেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ও চার কমিশনার পদত্যাগ করেন।
এরপর, নির্বাচন কমিশন ডেটা সেন্টারের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ১৭ই সেপ্টেম্বর টাইগার আইটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে নির্বাচন ভবনে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের কর্মকর্তারা টাইগার আইটি এবং আইবিসিএস প্রাইমেক্স সফটওয়্যারের কাছ থেকে ডেটা সেন্টারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে টাইগার আইটির কর্মকর্তারা নিজেদের বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদ বলে দাবি করে কিছু প্রযুক্তি হস্তান্তরে আপত্তি জানান।
টাইগার আইটির অবস্থান
টাইগার আইটির পরিচালক এএইচএম রাশেদ সরওয়ার জানান, ডেটা সেন্টারের প্রযুক্তিগত উন্নয়নে তাদের বিশাল অবদান রয়েছে। তিনি বলেন, তারা ডেটাবেজের স্কেমা, এপিআই-এর সোর্স কোড, ক্রেডেনশিয়াল এবং অন্যান্য বিষয়গুলো ইসিকে বুঝিয়ে দেবেন। তবে, তাদের অটোমেটিক বায়োমেট্রিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেমের (এবিআইএস) কোর ম্যাচিং অ্যালগরিদমের সোর্স কোড হস্তান্তর করা হবে না, কারণ এটি তাদের নিজস্ব উদ্ভাবন।
তিনি আরও বলেন, টাইগার আইটির সময়কালে ডেটাবেজে কোনো ধরনের তথ্য হ্যাক বা চুরি হয়নি।
নির্বাচনী ডেটাবেজের গুরুত্ব
নির্বাচন কমিশন প্রতিবছর ২ মার্চ ভোটার দিবস উদযাপন করে এবং এদিন হালনাগাদ করা ভোটার তালিকা প্রকাশ করে। ২০২৪ সালের ২ মার্চ প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী দেশের ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার ১৬০ জন। নতুন ভোটাররা প্রতিনিয়ত তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন।
এই ডেটাবেজ মূলত ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সেনাবাহিনীর সহায়তায় গড়ে ওঠা “অপারেশন নবযাত্রা” প্রকল্পের মাধ্যমে চালু হয়েছিল। এরপর থেকে বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি এবং সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভোটার ডেটাবেজটি হালনাগাদ এবং সমৃদ্ধ করা হয়েছে।
নিরাপত্তা ঝুঁকির আশঙ্কা
নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আজিম বলেন, ডেটা সেন্টারের সোর্স কোড ডেটা সেন্টারের “চাবি” হিসাবে কাজ করে। এই “চাবি” অন্যের হাতে থাকা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই, টাইগার আইটির কাছ থেকে সোর্স কোড সংগ্রহের জন্য তারা একটি টিম গঠন করেছেন এবং এই প্রক্রিয়ার জন্য টাইগার আইটিকে একটি সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও, ইসির পক্ষ থেকে টাইগার আইটির কাছে ইসির কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে, যাতে তারা ডেটা সেন্টারের রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে।
অনিয়মের অভিযোগ
সম্প্রতি, সরকারের এক গোপনীয় প্রতিবেদনে টাইগার আইটির সুবিধা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন নির্বাচনী কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। এসব কর্মকর্তাদের মধ্যে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী অন্যতম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের আইডিইএ প্রকল্পে টেন্ডারের শর্ত এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল যাতে টাইগার আইটি বিশেষ সুবিধা পায়।