গত মঙ্গলবার রাতে বাংলাদেশ পুলিশ গ্রেফতার করেছে দিলীপ কুমার আগরওয়ালাকে, দেশের অন্যতম বিশিষ্ট স্বর্ণ ব্যবসায়ী এবং ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সিআইডির (ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট) অভিযোগ, মি. আগরওয়ালা একটি সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেট পরিচালনা করতেন। এছাড়াও, সিআইডি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সোনা ও হীরা আমদানির নামে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে।
গ্রেফতারের পর, সোনা বাজারে তথাকথিত ‘সিন্ডিকেট’ ভেঙে দাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কি না, সেই বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বৈধ পথে সোনা আমদানি হয় না, এবং এই খাতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সোনার মূল্য নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ অনেকদিন ধরেই চলমান।
বাংলাদেশে সোনা আমদানির বর্তমান চিত্র
২০১৮ সালে সরকার সোনা আমদানি নীতিমালা প্রণয়ন করে, যা ২০২১ সালে সংশোধিত হয়। স্বর্ণের বাজার এবং জুয়েলারি ব্যবসায় স্বচ্ছতা আনার উদ্দেশ্যে ২০২১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে সোনা আমদানির লাইসেন্স দেয়। তবে, শুরুর দিকে পাঁচ-ছয়টি প্রতিষ্ঠান কিছু সোনা আমদানি করলেও পরে তা থেমে যায়।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের দাম নির্ধারণ কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমানের মতে, “আগের সরকারের সোনা আমদানির নীতিমালা ত্রুটিপূর্ণ ছিল। আমরা বহুবার আবেদন করেছি যে, সোনার আমদানির সুযোগ দেয়া হলেও কার্যত তা সম্ভব হয়নি।”
সোনা আমদানির নীতিমালার জটিলতা ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ
বাংলাদেশে বৈধ পথে সোনা আমদানি না হওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হলো আমদানির প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। মি. রহমান জানান, “গোল্ড ইমপোর্টের জন্য পারমিশন থেকে শুরু করে সব প্রক্রিয়া শেষ করতে প্রায় ২৪ থেকে ২৫ দিন লেগে যায়।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, “পাঁচ-ছয়জন আমদানিকারক সোনা আমদানি করেছিল, কিন্তু তারা এই সব বাধার কারণে আর সামনে এগোতে পারেনি।”
ব্যবসায়ীদের দাবি, সরকার একদিকে আমদানি নীতিমালা করে সোনা আমদানির সুযোগ দেয়, অথচ ব্যাগেজ রুলসে শিথিলতা প্রদান করে। ব্যাগেজ রুলসে এক ভরি সোনা মাত্র চার হাজার টাকায় দেশে আনার সুযোগ রয়েছে, যা সোনা আমদানির প্রচেষ্টাকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করছে।
সোনার বাজারে সিন্ডিকেটের প্রভাব ও দামের নিয়ন্ত্রণ
বাংলাদেশের সোনা বাজার মূলত নিয়ন্ত্রণ করে রাজধানী ঢাকার তাঁতীবাজারে অবস্থিত বুলিয়ান মার্কেট। ব্যবসায়ীদের দাবি, এই মার্কেটের সিন্ডিকেটের প্রভাবে সোনার দাম নির্ধারিত হয়। বাজুসের দাবি অনুযায়ী, তাঁরা এই সিন্ডিকেটের কাছে ‘অসহায়’। মি. রহমান বলেন, “তাঁতীবাজারের বুলিয়ান মার্কেট যে সোনার রেট নির্ধারণ করে, বাজুস সেই রেটকেই অনুসরণ করতে বাধ্য।”
ব্যবসায়ীদের মতে, দেশের বাজারে যে সোনা আসে তা মূলত চোরাচালানের মাধ্যমে আসে। এছাড়াও, আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দামের সাথে সামঞ্জস্য রাখা হয় না, বরং তাঁতীবাজারের সিন্ডিকেট নিজেরা মুনাফা অর্জনের জন্য উচ্চ হারে দাম নির্ধারণ করে।
সোনার দামের ব্যবধান: বাংলাদেশ বনাম ভারত
বাংলাদেশে বুধবার ২২ ক্যারেট প্রতি ভরি সোনার দাম ছিল এক লাখ ২৬ হাজার ৩২১ টাকা, যেখানে একই দিনে ভারতের কলকাতায় ২২ ক্যারেট এক ভরি সোনার দাম বাংলাদেশি টাকায় ছিল এক লাখ দশ হাজার ৬৫৩ টাকা। অর্থাৎ, দুই দেশের সোনার দামের পার্থক্য প্রায় পনের হাজার ৬৬৮ টাকা।
সোনা চোরাচালান রোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সোনা চোরাচালান রোধ করতে হলে দেশের মূল চোরাচালানকারীদের চিহ্নিত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সমন্বিতভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়াও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সোনা চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হয় – এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন ছাড়া চোরাচালান-কেন্দ্রিক এই খাতকে রক্ষা করা কঠিন হবে।”
সোনা আমদানির নীতিমালা সহজীকরণ ও বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা মনে করেন, “যদি দেখি বৈধ পথে সোনা আমদানির জন্য সরকারকে নির্দিষ্ট মূল্য পরিশোধ করে আনা হয়, তাহলে সরকারকে এনকারেজ করতে হবে। অর্থাৎ বৈধ পথে আনার বিষয়কে এনকারেজ করার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায় সরকারের সেটা নেয়া দরকার।”
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সোনা আমদানির নীতিমালা সহজতর করতে এবং বাজারে সঠিকভাবে দাম নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আরও কার্যকরী ভূমিকা প্রয়োজন। চোরাচালান রোধে এবং বৈধ পথে সোনা আমদানির প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য সরকারের উচিত নীতিমালা সংশোধন এবং নতুন আইনি কাঠামো তৈরি করা।
নিষ্কর্ষ
সোনার বাজারে স্বচ্ছতা আনা, সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় দাম নির্ধারণ, এবং চোরাচালান রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে এ খাতের অনিয়ম এবং সিন্ডিকেটের প্রভাব কমানো সম্ভব। গ্রেফতারকৃত দিলীপ কুমার আগরওয়ালার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সোনা খাতে নতুন নীতিমালা ও আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে উঠেছে, যা দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন এবং স্বর্ণ ব্যবসায় স্বচ্ছতা আনতে সহায়ক হবে।