বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক মহীরুহ, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে তাঁর অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। ভারত সিরিজের প্রথম টেস্টের আগের দিন এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে কিছুটা অবাক করেছেন তিনি। টেস্ট ফরম্যাটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আগামী সিরিজ খেলে সাদা পোশাক তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সাকিব। আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁর শেষ ম্যাচটি খেলা হয়ে গেছে গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই। তবে, ওয়ানডে ফরম্যাটে আরও কিছুদিন খেলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তিনি, যা আগামী বছরের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
টেস্ট থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা
টেস্ট ক্রিকেটে সাকিব আল হাসানের দীর্ঘ এবং উজ্জ্বল ক্যারিয়ার ধীরে ধীরে সমাপ্তির পথে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঘরের মাঠে শেষ টেস্ট সিরিজ খেলে এই ফরম্যাট থেকে বিদায় নেবেন সাকিব। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সাকিব বলেন, “এখন পর্যন্ত আমি টেস্টে এভেলেবল আছি, তবে এই সিরিজ আর হোম সিরিজটা আমার শেষ টেস্ট সিরিজ হবে।” এ ঘোষণার মাধ্যমে সাকিব ইঙ্গিত দেন, নিজের ইচ্ছায় নয় বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুযোগ তৈরি করতেই তিনি সরে দাঁড়াচ্ছেন।
টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার কারণ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সাকিব বলেন, “কোনো কষ্ট বা অভিমান থেকে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। বরং আমি মনে করি এখন সঠিক সময় নতুনদের সুযোগ দেওয়ার। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে হলে এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া জরুরি।” তাঁর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, তিনি নতুন খেলোয়াড়দের জায়গা করে দিতে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজের ক্যারিয়ারের এই অধ্যায়টি বন্ধ করতে যাচ্ছেন।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও ইতি
টেস্টের মতো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও সাকিবের অবসরের ঘোষণা এসেছে। তিনি জানিয়েছেন যে, “টি-টোয়েন্টি থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়টি নির্বাচন কমিটি এবং বোর্ডের সবার সঙ্গেই আলোচনা করেছি। এখন আমি এই ফরম্যাটে আর খেলতে চাই না। নতুন খেলোয়াড়দের সুযোগ দেওয়ার সময় এসেছে।”
যদিও সাকিব সরাসরি জানিয়েছেন যে, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তাঁর শেষ ম্যাচ খেলা হয়ে গেছে, তারপরও তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, ভবিষ্যতে দলের প্রয়োজন হলে এবং নিজেকে যথেষ্ট ফিট এবং পারফর্ম করতে দেখলে, টি-টোয়েন্টিতে আবারও ফিরতে পারেন। তাঁর ভাষায়, “আমি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলতে থাকি। ছয় মাস–এক বছর পর যদি বিসিবি মনে করে আমি টি-টোয়েন্টিতে কন্ট্রিবিউট করতে পারি, পারফর্ম করছি এবং ফিট আছি, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি।”
তবে আপাতত সাকিব আর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলতে চান না। তাঁর মতে, এখন সময় এসেছে নতুন খেলোয়াড়দের জন্য সুযোগ তৈরি করার, যাতে তারা নিজেদের প্রমাণ করতে পারে এবং ভবিষ্যতে দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে পারে।
ওয়ানডে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সাকিব ওয়ানডে ফরম্যাটেও আর বেশিদিন খেলতে চান না। তিনি জানিয়েছেন যে, “চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলে আমি ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে অবসর নিতে চাই। এটাই সম্ভবত আমার পরিকল্পনা।” তাঁর কথা অনুযায়ী, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে বাংলাদেশ মাত্র ৯টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলবে, যা সাকিবের জন্য ওয়ানডে ফরম্যাটে শেষ দিকের ম্যাচ হতে পারে।
সাকিবের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। দেশের জন্য দীর্ঘদিন ধরে খেলে আসা এই মহাতারকা যখন নিজেকে সরে দাঁড়ানোর কথা বলছেন, তখন একদিকে যেমন সাকিবকে হারানোর শূন্যতা তৈরি হবে, অন্যদিকে নতুন খেলোয়াড়দের জন্য সুযোগের দরজা খুলবে। তবে সাকিবের এই সিদ্ধান্ত কোনো হঠাৎ নেওয়া পদক্ষেপ নয়। তাঁর সঙ্গে নির্বাচন কমিটি, বোর্ড এবং কোচের আলোচনা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা
সাকিব আল হাসান দীর্ঘদিন ধরে দেশের হয়ে খেলছেন এবং দেশকে বিশ্বের ক্রিকেট মানচিত্রে তুলে ধরতে তাঁর অবদান অপরিসীম। অবসর ঘোষণার সময়ও তিনি দেশের প্রতি তাঁর দায়িত্ব এবং ভালোবাসার কথা স্পষ্ট করেছেন। তাঁর মতে, দেশের পরিস্থিতি এবং নিরাপত্তা নিয়ে ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, “আমি যেন দেশে ফিরে এসে খেলতে পারি এবং নিরাপদে অনুভব করতে পারি, সেটা নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।”
সাকিব আরও বলেন যে, দেশের বাইরে থাকা এবং দেশের মধ্যে ফেরার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও তাঁর জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বোর্ডের সঙ্গে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এবং তিনি আশা করেন, সব কিছু ঠিকঠাক হলে মিরপুরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শেষ টেস্টে অংশ নিতে পারবেন।
সাকিবের ক্যারিয়ারের মূল্যায়ন: রিজনেবললি ওকে!
সাকিব আল হাসান তাঁর ক্যারিয়ার সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে মুচকি হেসে বলেন, “আমি মনে করি, আমি রিজনেবলি ওকে করেছি। আমি খুশি, কোনো অনুশোচনা নেই। জীবনে কখনও অনুশোচনা ছিল না, এখনো নেই। যত দিন উপভোগ করেছি, আমি ক্রিকেট খেলেছি।” তাঁর কথায় স্পষ্ট, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে তিনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট এবং কোনো আক্ষেপ নেই।
সাকিব বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে এক অমূল্য রত্ন। বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। তাঁর ক্যারিয়ার দীর্ঘ এবং সাফল্যমণ্ডিত। ব্যাট এবং বল হাতে তিনি বাংলাদেশের জন্য অসংখ্য ম্যাচে অবদান রেখেছেন এবং তাঁর নেতৃত্বে দলকে বহু সাফল্যের পথে নিয়ে গেছেন। তবে এখন সময় এসেছে সাকিবের জন্য নতুন অধ্যায়ের সূচনা করার এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়দের জায়গা করে দেওয়ার।
নতুন প্রজন্মের জন্য সুযোগ
সাকিবের অবসর ঘোষণার পেছনে মূল কারণ হিসেবে নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়দের সুযোগ দেওয়ার ইচ্ছাই বড় ভূমিকা রেখেছে। তিনি মনে করেন, তাঁর সরে দাঁড়ানো বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য একটি সঠিক পদক্ষেপ। নতুন খেলোয়াড়দের উঠে আসা এবং নিজেদের প্রমাণ করার সময় এখনই। “২০২৬ সালের দিকে যদি বাংলাদেশ ক্রিকেট তাকায়, তাহলে এটাই বাংলাদেশের জন্য ভালো।”
সাকিব আরও বলেন যে, তিনি নির্বাচক, কোচ এবং বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সবাই একমত হয়েছে যে, এখন সময় নতুনদের জন্য সুযোগ তৈরি করার।