বাংলাদেশে সরকারের নিয়মিত মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে চার বছর করার প্রস্তাব নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক এক মন্তব্যের পর বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে।
তবে এটি তার ব্যক্তিগত অভিমত, নাকি অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়।
প্রধান উপদেষ্টার মন্তব্য ও বিতর্কের সূচনা
সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “নতুন সংবিধানে হয়তো নিয়মিত সরকারের মেয়াদ চার বছর হচ্ছে।”
তার এই বক্তব্যের পরই সরকারের মেয়াদ কমানো নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
তিনি বলেন, “জনগণ দ্রুত অগ্রগতি চায়, এ কারণেই মেয়াদ চার বছর করার কথা ভাবা হতে পারে।”
এই মন্তব্য ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
বিএনপি এবং অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দল এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক অবস্থান নেয়নি।
তবে, শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এ ধরনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “তিনি (মুহাম্মদ ইউনূস) স্পষ্টভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ চার বছর হবে এমন কোনো কথা বলেননি।”
তবে, সাক্ষাৎকারের পরে এই ইঙ্গিত যে জনমনে গভীর প্রভাব ফেলেছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
সরকারের মেয়াদ কমানোর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচিত সংসদ ও সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর।
এটি পরিবর্তন করতে হলে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন, যা কেবল নির্বাচিত সংসদই করতে পারে।
দেশে এর আগে কখনো সরকারের মেয়াদ কমানোর কোনো প্রস্তাব গুরুত্ব পায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, “সংসদ বা সরকারের মেয়াদ কমানোর আলোচনা আগে কখনো শুনিনি। এর প্রয়োজনীয়তা কোথায় তা বুঝতে পারছি না।”
বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “শাসক ভালো না হলে মেয়াদ চার বছর হলেও খারাপ হবে। গণতন্ত্র থাকলে মেয়াদ বড় কোনো ইস্যু নয়।”
তিনি মনে করেন, সরকারের কাজের মানই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, মেয়াদ নয়।
১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর তিন জোটের রূপরেখায় সরকারের মেয়াদ নিয়ে কোনো পরিবর্তনের কথা উল্লেখ ছিল না।
এরপর বিএনপি, আওয়ামী লীগ কিংবা অন্যান্য বড় রাজনৈতিক দলের সংস্কার প্রস্তাবেও এই বিষয়টি উঠে আসেনি।
আন্তর্জাতিক উদাহরণ
বিশ্বজুড়ে অনেক দেশেই সরকারের মেয়াদ চার বছর বা পাঁচ বছর নির্ধারিত।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ চার বছর, যা এ ধরনের সরকারের সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ।
ইউরোপের দেশ জার্মানি, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক এবং কানাডায়ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ চার বছর।
তবে, যুক্তরাজ্য, ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর।
বাংলাদেশও যুক্তরাজ্যের ওয়েস্টমিনিস্টার পদ্ধতি অনুসরণ করে, যেখানে পাঁচ বছর মেয়াদ নির্ধারিত।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নিয়মিত সরকারের মেয়াদ কমানো একটি অস্বাভাবিক প্রস্তাব বলে মনে করছেন অনেকে।
বিএনপির প্রতিক্রিয়া
সরকারের মেয়াদ নিয়ে বিএনপি সরাসরি কোনো অবস্থান জানায়নি।
তবে, দলটির শীর্ষ নেতারা মনে করেন, বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “নির্বাচন কমিশনকে ঠিক করে, প্রশাসনকে ঠিক করে নির্বাচনের দিকে যাওয়া উচিত। বাকিগুলো নির্বাচিত সরকার করবে।”
বিএনপির মতে, সরকারের মেয়াদ কমানো বা বাড়ানো নয়, বরং গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনর্গঠন এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করাই জরুরি।
তারা মনে করেন, এমন বিতর্ক আসন্ন নির্বাচন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দিতে পারে।
সংবিধান সংস্কারের কমিশনের ভূমিকা
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
কমিশনের রিপোর্ট আগামী জানুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়ার কথা।
সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবে সরকারের মেয়াদ নিয়ে কোনো সুপারিশ উঠে আসে কি না, তা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
যদিও আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, চার বছরের মেয়াদ নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি।
তিনি বলেন, “চার বছরের বিষয়টি পুরোপুরি ‘আউট অফ কনটেক্সট’। এ ধরনের কিছু বলাই হয়নি।”
প্রধান উপদেষ্টার মন্তব্যের ভবিষ্যৎ প্রভাব
প্রধান উপদেষ্টার মন্তব্য নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের প্রত্যাশার উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
সরকারের মেয়াদ কমানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র নির্বাচিত সংসদকেই নিতে হবে।
তবে, সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ যদি এই প্রস্তাবকে সমর্থন করে, তাহলে সেটি রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি করতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই বিতর্ক আসন্ন নির্বাচনের পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
তারা মনে করেন, সরকারের মেয়াদ চার বছর করা একটি দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত, যা তড়িঘড়ি করে নেওয়া উচিত নয়।
এখন প্রশ্ন থেকে যায়, সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে এই প্রস্তাবকে মূল্যায়ন করবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সামনের কাজ হবে, এই বিতর্কের মধ্যেও একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করা।