ব্যাংক
, ,

সরকারি বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যাংক ঋণ: বাংলাদেশের অর্থনীতির নতুন সংকট?

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও সরকার কর্তৃক ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার ফলে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসে। সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার ফলে পরিচালন ব্যয় মেটাতে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১২ হাজার ৭১১ কোটি টাকা ঋণ নিতে বাধ্য হয়।

অর্থনীতিবিদরা এ ঘটনাকে একটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের পূর্বাভাস হিসেবে দেখছেন। অর্থনীতির স্থিতিশীলতার ঘাটতি এবং সরকারের উচ্চ ব্যয় ব্যবস্থাপনা আগামীতে আরও বড় সংকটের সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ব্যাংক ঋণের ওপর সরকারের নির্ভরতা

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাইয়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। এই ঋণ প্রধানত সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে। অথচ আগের বছর জুলাইয়ে এই ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে সরকারের ব্যাংক ঋণ পাঁচগুণেরও বেশি বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদরা জানাচ্ছেন, জুলাই মাস সাধারণত সরকারি ব্যয়ের জন্য চাপের সময় নয়। তবে চলতি অর্থবছরে সরকারি ব্যয়ের ব্যাপক বৃদ্ধি এবং রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের ঘাটতির কারণে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে, বেতন-ভাতা এবং সুদের পরিশোধে ব্যয়ের অংশ সবচেয়ে বেশি।

রাজস্ব আহরণ ও ব্যয়ের অসামঞ্জস্যতা

চলতি অর্থবছরে সরকার ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বাস্তবে এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) জুলাই মাসে মাত্র ২০ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করতে পেরেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় অর্ধেক। ফলে, রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের মধ্যে একটি বড় ধরনের ফাঁক থেকে যাচ্ছে। এর ফলে, সরকারকে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের খরচ ক্রমশ বাড়ছে, কিন্তু রাজস্ব আহরণ সেই অনুযায়ী বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বেতন-ভাতা এবং ঋণের সুদ পরিশোধের মতো বাধ্যতামূলক ব্যয়গুলো মেটাতে সরকারকে বাধ্য হয়ে ব্যাংক ঋণ নিতে হচ্ছে, যা অর্থনীতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি চাপ তৈরি করতে পারে।

আন্দোলন ও অস্থিরতার প্রভাব

২০২৪ সালের জুলাই মাস ছিল দেশব্যাপী রাজনৈতিক উত্তেজনা ও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল। আন্দোলনের জেরে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়, যা দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে স্থবির করে দেয়। এ অবস্থায় সরকার লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে রাজস্ব আহরণ করতে পারেনি। ফলস্বরূপ, সরকারের খরচ বাড়লেও আয় কমে যায়, যা ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতাকে বাড়িয়ে তোলে।

অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরীর মতে, “জুলাই মাসের বড় অংশ আন্দোলন ও অস্থিরতায় কাটায়, যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করেছে। সরকার কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আহরণ করতে না পারায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চলতে হয়েছে।”

ব্যাংক ঋণের ভবিষ্যৎ প্রভাব

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন যে, সরকারের ব্যাংক ঋণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা বেসরকারি খাতে ঋণ প্রদানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুজেরী জানান, “যদি সরকার ব্যাংক ঋণ কম নেয়, তাহলে বেসরকারি খাত বেশি ঋণ পাবে, যা অর্থনীতিকে পুনরায় শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে।”

সরকারের পরিচালন ব্যয়ের বাস্তবতা

অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিচালন ব্যয়ের আকার ছিল ৪ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বড় একটি অংশ ব্যয় হয়েছে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও ঋণের সুদ পরিশোধে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পরিচালন ব্যয় আরও বৃদ্ধি পেয়ে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে, যেখানে শুধুমাত্র ঋণের সুদ পরিশোধেই ব্যয় হবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

গত অর্থবছরে সরকারের বাজেট ঘাটতি ছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। এ ঘাটতি পূরণে সরকার বিদেশি ঋণ এবং ব্যাংক ঋণ নেয়। তবে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি এবং ব্যাংক ঋণের পরিমাণ যদি বাড়তে থাকে, তাহলে সরকারের আর্থিক সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।

অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও ঋণ সহায়তা

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি সহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে নতুন নতুন ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাচ্ছে। যদি এসব ঋণ দ্রুত দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়, তাহলে সরকারের ব্যাংক ঋণনির্ভরতা অনেকটাই কমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই ঋণগুলোর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি পুনরায় স্থিতিশীল করা সম্ভব হবে।

অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হানের মতে, “বাংলাদেশের অর্থনীতি গত কয়েক বছর ধরেই সংকটে ছিল। বিভিন্ন সংকট যেমন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, বাজেট ঘাটতি—এসব সমস্যার সমাধান না হওয়ায় অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে, অন্যথায় সংকট আরও বাড়বে।”

সম্পাদকীয় বিশ্লেষণ

সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি এবং রাজস্ব আহরণের ঘাটতি বাংলাদেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে। সাম্প্রতিক ব্যাংক ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কেবল তাৎক্ষণিক আর্থিক সংকট মেটানোর জন্যই উপযুক্ত হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

সরকারের উচিত ব্যাংক ঋণ কমিয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া। পাশাপাশি রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর জন্য সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এর পাশাপাশি, বৈদেশিক ঋণ সহায়তার যথাযথ ব্যবহার করতে হবে, যাতে আর্থিক ব্যবস্থার ওপর চাপ কমে আসে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম শক্তিশালী হয়।

বর্তমান পরিস্থিতিতে, স্থায়ী অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি। স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকারের উচিত স্বচ্ছ নীতি-কৌশল প্রণয়ন এবং রাজস্ব ও ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা। অন্যথায়, বাংলাদেশকে আরও গভীর আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হতে হতে পারে, যা দেশের উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোকে বড় ধরনের বাধার মুখে ফেলবে।

আরও পড়তে পারেন