,

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২, বিসিএস পরীক্ষায় সর্বোচ্চ তিনবার অংশগ্রহণ: সিদ্ধান্ত ঘিরে বিতর্কের ঝড়

নতুন নিয়ম নিয়ে জনমনে ধোঁয়াশা, ভিন্নমত ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ বছর নির্ধারণ এবং বিসিএস পরীক্ষায় একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ তিনবার অংশগ্রহণ করতে পারবেন – এমন একটি সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, আবার কেউ কেউ এটিকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে জনমনে এখনো রয়েছে নানা ধরণের ধোঁয়াশা ও প্রশ্ন।

এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে সরকার বলছে, বয়সসীমা ও পরীক্ষার সংখ্যা নির্ধারণের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে অধিক যোগ্য প্রার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থী এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নিয়ম কার্যকর হলে শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি চাকরির দ্বার আরও সংকীর্ণ হয়ে যাবে।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা এবং বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সংখ্যা নিয়ে চলমান বিতর্কের পেছনে রয়েছে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন। তারা বয়সসীমা ৩৫ বছর এবং পরীক্ষার সুযোগ অন্তত আটবার করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করে আসছিলেন। তবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গতকাল একটি বৈঠকে এই দাবি নাকচ করে দিয়ে নতুন এই নিয়মের ঘোষণা দেয়।

নতুন সিদ্ধান্তে দেশজুড়ে আলোচনা

সরকারের এ সিদ্ধান্তটি গতকাল প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়। কেউ কেউ বলছেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ বছর করা একটি যথাযথ সিদ্ধান্ত, আবার কেউ কেউ মনে করছেন এতে সাধারণ প্রার্থীদের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি হবে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন নানা চ্যালেঞ্জে মুখোমুখি হয়, সেখানে সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৩৫ বছর হওয়া উচিত ছিল।

তবে সরকার বলছে, বয়সসীমা ৩২ বছর এবং বিসিএসে সর্বোচ্চ তিনবার পরীক্ষার সুযোগ নির্ধারণের মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যা দেশের জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য।

এ বিষয়ে সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “বয়সসীমা বাড়ানো হলে অধিকাংশ প্রার্থীরা একাধিকবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন, কিন্তু নতুন প্রার্থীদের সুযোগ কমে যাবে।”

বয়সসীমা বৃদ্ধি না করায় আন্দোলনকারীদের হতাশা

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সরকারের এই সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করেছেন। বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের আন্দোলনের প্রধান দাবি পূরণ করেনি। আমাদের দাবি ছিল বয়সসীমা ৩৫ বছর করা এবং বিসিএসে অন্তত আটবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া।”

বক্তব্যে শিক্ষার্থীরা উল্লেখ করেন, তাদের জীবনে বহুবার দেখা গেছে যে নানা কারণে তাদের পড়াশোনা ও পরীক্ষায় বিঘ্ন ঘটে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে কয়েক বছর শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছিল, যা এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। তারা মনে করেন, এসব বিবেচনায় বয়সসীমা বাড়ানো একটি বাস্তবিক সিদ্ধান্ত হতে পারত।

অনেকেই মনে করছেন, বিসিএস পরীক্ষা যেমন মানসিক চাপ এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রার্থীদের পরীক্ষা করে, তেমনি যারা ইতোমধ্যে তিনবার পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেই বিষয়েও সরকারের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

বয়সসীমা ও পরীক্ষার সুযোগ কমানোর পেছনে কারণ কী?

সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বয়সসীমা কমানোর পেছনে সরকারের যুক্তি হলো, উচ্চবয়সী চাকরিপ্রত্যাশীরা প্রবেশ করলে কর্মজীবনে মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে এবং এটি দীর্ঘমেয়াদী ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলতে পারে।

সাবেক সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বলেন, “প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করলে একজন প্রার্থী চাকরিতে যোগদান করতে অনেক বিলম্বিত হতে পারে, যার ফলে চাকরিজীবনের শুরুতেই মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে। দুই বছর বাড়ানো যুক্তিসঙ্গত; তবে আরও বেশি সময় বৃদ্ধি করা উচিত নয়।”

এছাড়াও, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “করোনা এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মতো বিষয়গুলো ক্ষণস্থায়ী। সরকার অস্থায়ী কারণের ভিত্তিতে বয়সসীমা বাড়ানোর প্রস্তাবকে মান্যতা দিচ্ছে না।”

বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “যদি বেশি বয়সী প্রার্থীরা বারবার পরীক্ষা দেয়, তবে নতুন প্রার্থীদের সুযোগ কমে যেতে পারে। ফলে সরকারি চাকরির জন্য অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে বয়স ৩২ রাখাটাই যুক্তিসঙ্গত মনে হচ্ছে।”

অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

বিসিএস পরীক্ষায় সর্বোচ্চ তিনবার অংশগ্রহণের সুযোগ রাখার বিষয়টিতে জনমনে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, যারা ইতোমধ্যে তিনবার পরীক্ষা দিয়েছেন, তারা নতুন নিয়মের কারণে ভবিষ্যতে পরীক্ষা দিতে পারবেন না।

সাবেক সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বলেন, “সরকারি প্রজ্ঞাপন কার্যকর হবে জারি হওয়ার পর থেকে। ফলে যারা ইতোমধ্যে তিনবার পরীক্ষা দিয়েছেন, তাদের ওপর নতুন নিয়ম প্রযোজ্য নাও হতে পারে।”

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানও এই বিষয়টি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো মন্তব্য করতে পারেননি। তার মতে, প্রজ্ঞাপনের পরই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

অনেক প্রার্থী মনে করছেন, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অধিকতর সুযোগ পাওয়া উচিত, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের পক্ষে সহায়ক হবে। তবে, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলছেন, “সর্বোচ্চ তিনবার পরীক্ষা দেওয়ার নিয়ম পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই।”

সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে সামাজিক প্রতিক্রিয়া

সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে চলছে নানা ধরণের আলোচনা ও বিতর্ক। কেউ কেউ বলছেন, বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের জীবনে বিভিন্ন ধরণের চ্যালেঞ্জ দেখা যায়, যা তাদের পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, সরকারের উচিত ছিল এই বিষয়টি আরও ভেবে দেখা এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা।

তবে, সরকারের কিছু কর্মকর্তা মনে করেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়স্ক প্রার্থীদের সুযোগ দিলে দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। এছাড়াও, কম বয়সী প্রার্থীরা অধিকতর কর্মক্ষম এবং দক্ষ হওয়ায় তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা ও পরীক্ষা সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের ভবিষ্যৎ

বর্তমান সিদ্ধান্তের পর থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে অসন্তোষের সঞ্চার হয়েছে। তারা বলছেন, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বর্ধিত বয়সসীমা এবং অধিকতর পরীক্ষার সুযোগ না থাকায় চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য এই সুযোগ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশজুড়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে যাবে এবং শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের স্বপ্ন ভঙ্গ হতে পারে। তবে সরকার বলছে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে দেশের অর্থনীতি ও জনসংখ্যা বিবেচনা করে।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, সরকার যদি দ্রুত এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করে তাহলে তারা বড় ধরনের আন্দোলনের দিকে যেতে বাধ্য হবেন।

আরও পড়তে পারেন