বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবি দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত বিষয়। বিভিন্ন শিক্ষার্থী ও তরুণদের মধ্যে এই দাবিকে ঘিরে আন্দোলনও গড়ে উঠেছে। তাদের দাবি, শিক্ষাজীবনে সেশনজট, করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারির কারণে চাকরির সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছেন। বয়সসীমা বাড়ানো হলে তারা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের আরও সুযোগ পেতেন। অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করা উচিত নয়, বরং এটা ৩০ থেকে ৩২ বছরের মধ্যে রাখা উচিত।
সরকারি চাকরিতে বয়সসীমার পরিবর্তনের ইতিহাস
ব্রিটিশ ভারতের সময় থেকেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ছিল বেশ কম। ১৮৯৫ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) পরীক্ষায় বসার সর্বনিম্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২১ বছর, এবং সর্বোচ্চ ছিল ২৩ বছর। পাকিস্তান আমলে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এ বয়সসীমা ২৪ বছর ছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ২৭ বছর। ১৯৯১ সালে এটি বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়।
বর্তমানে, সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের জন্য সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ৩২ বছর।
আন্দোলনকারীদের যুক্তি
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, দীর্ঘদিনের শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যা, সেশনজট, এবং কর্মজীবনে প্রবেশের দেরি তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগকে সীমিত করেছে। তারা উল্লেখ করছেন যে অনেক দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা অনেক বেশি, যেমন ভারতে এই বয়সসীমা ৩২ বছর। এছাড়া করোনার সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলায় অনেকেই চাকরির জন্য আবেদন করার সুযোগ পাননি।
তারা আরও উল্লেখ করছেন যে বাংলাদেশে গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার ফলে কর্মজীবনে দীর্ঘ সময় কাটানো সম্ভব, তাই প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো উচিত।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবিটি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করা হলে কর্মজীবনের একদম শেষ দিকে গিয়ে প্রার্থীদের অভিজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেন, “সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করা হলে সরকারি কর্মকর্তারা দক্ষ হয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে এবং তারা সরকারের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কোনো কার্যকর সেবা প্রদান করতে পারবেন না।”
সাবেক সচিবদের একজন বলেন, “বয়সসীমা ৩৫ বছর করা হলে শিক্ষার্থী এবং বেকারত্বের সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। এটা সাময়িক একটা সমস্যা মোকাবিলার জন্য উপযুক্ত হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এর কোনো প্রভাব থাকবে না।”
আন্তর্জাতিক উদাহরণ
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বিষয়ে আন্তর্জাতিক উদাহরণ তুলে ধরে আন্দোলনকারীরা উল্লেখ করছেন যে অনেক দেশে এই বয়সসীমা বেশি। ভারতে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩২ বছর, এবং সেখানে কিছু ক্ষেত্রে আরও বেশি বয়সে প্রার্থীরা আবেদন করতে পারেন। তবে ব্রিটেনে বা যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট বয়সসীমা নেই, বরং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রার্থীদের যোগ্যতা বিবেচনা করা হয়।
বয়সসীমা বৃদ্ধির পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি
বয়সসীমা ৩৫ বছর করার পক্ষে যারা, তাদের যুক্তি হলো, বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সাথে বয়সসীমা সমন্বিত নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘ সেশনজট, চাকরির ক্ষেত্রে দুর্নীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস—এই সব সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিক্ষা জীবন শেষ করতে পারেন না। এ কারণে তারা বয়সসীমা পার হওয়ার আগে সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করার সুযোগ পান না।
অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, বয়সসীমা ৩৫ করা হলে রাষ্ট্রের পক্ষে এটা দীর্ঘমেয়াদী কোনো সেবা প্রদান করতে পারবে না। শিক্ষাজীবন দীর্ঘ হওয়ার কারণে প্রার্থীরা কার্যকর সেবা প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাবেন না।
সমাধানের উপায়
বয়সসীমা বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরের সমস্যা সমাধানের ওপর জোর দেওয়া উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। শিক্ষা ব্যবস্থায় সেশনজট দূর করা, চাকরি পরীক্ষায় দুর্নীতি ও প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা, এবং চাকরির বাজারের চাহিদার সাথে শিক্ষার সমন্বয় ঘটানো এসব ক্ষেত্রে সমাধানের দিকে নজর দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেন, “সরকার যদি সত্যিই বেকারত্ব দূর করতে চায়, তবে প্রথমে দেখতে হবে কতগুলো পদ ফাঁকা আছে এবং কিভাবে ধাপে ধাপে সেগুলো পূরণ করা যায়।”
এছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়সসীমা বৃদ্ধির পরিবর্তে সরকারি চাকরির সুযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া উচিত, যাতে তরুণেরা আরও বেশি সুযোগ পান।
সার্বিক প্রেক্ষাপট
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবি নিয়ে দেশে এখনও বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সরকার এই বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে যা বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখছে। তবে বিশেষজ্ঞদের ভিন্নমত থাকায় এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ধরনের যুক্তি থাকার কারণে এই বিষয়ে এখনও সুস্পষ্ট সমাধান আসেনি।
অবশ্য আন্দোলনরত তরুণদের দাবি, তারা দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছেন এবং তাদের দাবি বাস্তবায়িত না হলে দেশের এক বিশাল শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠী বেকার থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে তারা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে পর্যালোচনা করছে এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।