,

সচিবালয়ে আগুন: নাশকতার শঙ্কা নাকচে তদন্ত কমিটির প্রাথমিক বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের সচিবালয়ে মধ্যরাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

এই অগ্নিকাণ্ড ঘিরে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব থেকে শুরু করে নানা প্রশ্ন ওঠে।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র থাকা ভবনে আগুন লাগার কারণ খুঁজতে গঠন করা হয় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি।

বুয়েট এবং সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত এই দল আগুনের সম্ভাব্য কারণ এবং প্রাসঙ্গিক আলামত নিয়ে কাজ করছে।

অগ্নিকাণ্ডের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো ছবি, সিসিটিভি ফুটেজ এবং ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া প্রমাণ নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক।

মঙ্গলবার উপস্থাপিত প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈদ্যুতিক লুজ কানেকশন থেকেই এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়।

তবে জনমনে সন্দেহের কারণ হয়ে ওঠা পাঁচটি প্রশ্ন নিয়ে তদন্তের গভীরতা এখনো বহাল।

অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত: বৈদ্যুতিক ত্রুটি নাকি ষড়যন্ত্র?

তদন্ত কমিটির মতে, আগুনের সূত্রপাত ঘটে সাত নম্বর ভবনের ছয়তলার সিঁড়ির কাছে।

সিসিটিভি ফুটেজে রাত ১টা ৩৬ মিনিটে বৈদ্যুতিক স্পার্ক থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।

কমিটির সদস্যরা নিশ্চিত করেছেন, প্রাথমিকভাবে কোনো বিস্ফোরণের আলামত পাওয়া যায়নি।

তদন্তে দেখা গেছে, বৈদ্যুতিক তারের লুজ কানেকশনের কারণে এই স্পার্ক তৈরি হয়।

এই লুজ কানেকশন দীর্ঘদিন ধরে ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, আগুন লাগার পর করিডোর ধরে এটি ছড়িয়ে পড়ে।

আগুন ছড়ানোর সময়কালে বিভিন্ন রুমে ঢুকে দাহ্য বস্তুতে লেগে আগুন বড় আকার ধারণ করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এসি বিস্ফোরণের মতো ঘটনা আগুনের তীব্রতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে।

তবে বৈদ্যুতিক উৎসের বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত করতে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হবে।

কেন দুটি স্থানে আলাদা আলাদা আগুন দেখা গেল?

অগ্নিকাণ্ডের একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তি তৈরি করে।

ছবিতে দেখা যায়, ভবনের দুই দিকে ভিন্ন দুটি রুমে আগুন জ্বলছে।

এটি নাশকতার তত্ত্বকে উসকে দেয়।

তদন্তে জানা গেছে, ছবিটি আগুন লাগার প্রায় আধা ঘণ্টা পর তোলা।

তখন করিডোর ধরে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে এবং বিভিন্ন রুমে প্রবেশ করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব রুমে দাহ্য বস্তু বেশি ছিল, সেগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এসি বিস্ফোরণের কারণে কয়েকটি রুমে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

তদন্ত কমিটির মতে, ছবি দেখে প্রাথমিকভাবে বিভ্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক।

তবে প্রকৃত বিশ্লেষণেই বোঝা গেছে, দুটি স্থানে একসঙ্গে আগুনের শুরু হয়নি।

নাশকতা: সাদা পাউডার ও বিস্ফোরণের প্রশ্ন

আগুন নেভার পর ভবনের ধ্বংসস্তূপে সাদা পাউডারের মতো একটি পদার্থ পাওয়া যায়।

এটি নিয়ে নাশকতার সন্দেহ আরও গভীর হয়।

সেনাবাহিনী এবং বুয়েটের পরীক্ষায় দেখা গেছে, এটি চুন জাতীয় পদার্থ।

কোনো বিস্ফোরণ বা ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) ব্যবহার হয়নি।

সিসিটিভি ফুটেজেও আগুন ছড়ানোর কোনো অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায়নি।

তদন্ত কমিটির সদস্যরা বলছেন, বৈদ্যুতিক স্পার্ক ধীরে ধীরে আগুন ছড়িয়েছে।

তাদের ভাষায়, “সময় নিয়ে আগুন ছড়ানো নাশকতার তত্ত্ব নাকচ করে।”

তদন্তে কোনো বাইরের হস্তক্ষেপের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

তবে ভবিষ্যৎ পরীক্ষায় এ বিষয়ে আরও নিশ্চিত হওয়া হবে।

কুকুরের উপস্থিতি: নাশকতার নেপথ্যে কোনো সূত্র?

সচিবালয়ের ছয়তলায় একটি কুকুরের মরদেহ উদ্ধার ঘটনাটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।

অগ্নিকাণ্ডের পরপরই প্রশ্ন ওঠে, বন্ধ ভবনে কুকুরটি ঢুকল কীভাবে।

তদন্ত কমিটি সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে, কুকুরটি আগুন লাগার আগে ওই তলায় প্রবেশ করে।

ভিডিওতে দেখা যায়, এটি ভবনের একটি চেয়ারে শুয়ে ছিল এবং আগুনের তাপে সেখানেই মারা যায়।

তবে ফুটেজে কুকুরটির ভবনে প্রবেশের মুহূর্ত ধরা পড়েনি।

কমিটির সদস্যরা বলছেন, কুকুরটি ভবনের একটি খোলা অংশ দিয়ে ঢুকে থাকতে পারে।

তদন্তে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, আগের ২৪ ঘণ্টার ফুটেজ আরও বিশদভাবে পর্যবেক্ষণ করতে।

তারা মনে করছেন, কুকুরের উপস্থিতি নাশকতার কোনো প্রমাণ হিসেবে বিবেচ্য নয়।

তবে ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে এই ঘটনা।

আগুন নেভাতে বিলম্ব: ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবন্ধকতা

অগ্নিকাণ্ডের সময় ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছায় মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে।

তবে বড় গাড়ি নিয়ে সচিবালয়ের মূল গেট পেরোতে তাদের বেশ সময় লাগে।

সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভবনে ফায়ার অ্যালার্ম এবং দ্রুত কার্যকরী অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা ছিল না।

তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, ছয়তলার করিডোরে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সময় ফায়ার ডিটেক্টরও কার্যকর ছিল না।

ফায়ার সার্ভিসের হোসপাইপগুলোও ব্যবহার উপযোগী অবস্থায় পাওয়া যায়নি।

অনেক জায়গায় হোসপাইপ কাটা বা চুরি হয়ে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়টি ভবনের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতির দিকটি সামনে এনেছে।

বিল্ডিং কোড অনুসারে সচিবালয়ের মতো ভবনে উন্নত অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল।

তদন্ত কমিটির মতে, ফায়ার সার্ভিস দ্রুত পৌঁছালেও তাদের কার্যক্রমে দেরি হয় এসব প্রতিবন্ধকতার কারণে।

সচিবালয়ের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা: যে সুপারিশ করেছে কমিটি

তদন্ত কমিটি আগুনের প্রকৃত কারণ শনাক্তে ভবিষ্যৎ পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়েছে।

তারা পরামর্শ দিয়েছে, ভবনের আগের কয়েক দিনের ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করা দরকার।

জরুরি ভিত্তিতে ভবনের ফায়ার সেফটি সিস্টেম আধুনিকায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।

আগুন নেভানোর সরঞ্জাম এবং ফায়ার অ্যালার্ম নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় আনা উচিত।

তদন্ত কমিটি মনে করছে, ভবনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুরোপুরি পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন।

তারা বলেছে, ভবনের দাহ্য পদার্থ কমানোর জন্য নতুন নীতিমালা প্রয়োজন।

সংগ্রহীত আলামত বিদেশে পাঠিয়ে আরও পরীক্ষা করার পর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় এমন ঘটনা এড়াতে সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।

আরও পড়তে পারেন