Sri Lanka
,

শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন: রাজাপাকসা পরিবারের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা

শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তাল হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আলোচনায়, যেখানে ২১ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে রাজাপাকসা পরিবারের ফিরে আসার সম্ভাবনা সামনে এসেছে। নামাল রাজাপাকসা, যিনি দেশটির সাবেক রাষ্ট্রপতি মাহিন্দা রাজাপাকসার ছেলে, এবার প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে, এই প্রার্থিতা শ্রীলঙ্কার জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। দুই বছর আগেই এই পরিবারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলেও তারা এখন আবার রাজনীতির মূলধারায় প্রবেশের চেষ্টা করছে।

২০২২ সালের বিদ্রোহ: রাজাপাকসা পরিবারের পতন

২০২২ সালের জুলাই মাসের ১৩ তারিখ ছিল শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন। ওইদিন দেশটির রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসা সাধারণ মানুষের আন্দোলনের চাপে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। হাজার হাজার শ্রীলঙ্কান বিক্ষোভকারী কলম্বোর রাষ্ট্রপতি প্রাসাদ দখল করে। সেসময় রাষ্ট্রীয় কারফিউ উপেক্ষা করে তারা টিয়ার গ্যাস, জল কামান মোকাবেলা করেও শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। রাজাপাকসা পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।

শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট ও পরিবারের পতন

২০২২ সালের আন্দোলনের প্রধান কারণ ছিল শ্রীলঙ্কার ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট। বছরের পর বছর ধরে চালানো সরকারের ভুল নীতির কারণে দেশটি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। বিশেষ করে গোটাবায়া রাজাপাকসার আমলে নেয়া নীতিমালা সংকটের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত এই পরিবারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাকে দোষারোপ করেছে। শ্রীলঙ্কার জনতা জানতো, একবার গোটাবায়ার পতন হলে পুরো রাজাপাকসা পরিবারের রাজত্বও শেষ হবে।

আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসার চেষ্টা?

কিন্তু শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি আজও বেশিরভাগ মানুষের জন্য খুব একটা উন্নত হয়নি। গোটাবায়া রাজাপাকসা দেশ ছাড়ার মাত্র ৫০ দিন পর ফিরে এসেছিলেন এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি প্রাপ্য সব সুবিধা উপভোগ করতে থাকেন। এরমধ্যে আবারও নতুন করে নামাল রাজাপাকসা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তার প্রার্থিতা নিয়ে অনেকের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। শ্রীলঙ্কার অনেক মানুষই এই প্রার্থিতাকে রাজাপাকসা পরিবারের ফিরে আসার আরেক প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা

রাষ্ট্রপতি হিসেবে রনিল বিক্রমাসিংহে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নানা পদক্ষেপ নিলেও এখনো বহু সাধারণ মানুষ সমস্যায় রয়েছে। বিদ্যুতের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে, সরকারি ভর্তুকি বাতিল করা হয়েছে, এবং কল্যাণ খাতে ব্যয়ও কমানো হয়েছে। সরকারের নেওয়া কঠোর পদক্ষেপের কারণে লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপ না নিলে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ফেরানো সম্ভব হতো না। কিন্তু এর ফলে দেশের সাধারণ মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

নামাল রাজাপাকসার প্রচারণা: নতুন মুখ নাকি পুরনো উত্তরাধিকার?

নামাল রাজাপাকসা নিজেকে নতুন পরিবর্তনের দূত হিসেবে উপস্থাপন করছেন। তবে অনেকেই মনে করছেন, এটি মূলত তার বিতর্কিত পরিবারের রাজনৈতিক শক্তি ফিরে পাওয়ার আরেক প্রচেষ্টা। তার নির্বাচনি প্রচারণায় মাহিন্দা রাজাপাকসার উত্তরাধিকারকেই তুলে ধরা হচ্ছে। মাহিন্দা এখনও শ্রীলঙ্কার অনেকের কাছেই নায়ক হিসেবে বিবেচিত হন। তবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগও রয়েছে। জাতিসংঘের মতে, শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ৪০ হাজার তামিল বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছিল, যার দায় মাহিন্দা ও তার নেতৃত্বাধীন বাহিনীর ওপর চাপানো হয়।

নামাল রাজাপাকসার প্রচারণায় তার বাবার সঙ্গে ছোটবেলার ছবিও ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব ছবিতে তার গোঁফও দেখা যাচ্ছে, যেটি মাহিন্দার ট্রেডমার্ক হিসেবে পরিচিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত এসব ছবি মানুষকে মাহিন্দার উত্তরাধিকার ও পরিবারটির শক্তিশালী অবস্থান স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

জনগণের প্রতিক্রিয়া: রাজাপাকসাদের প্রতি আস্থা নাকি সন্দেহ?

শ্রীলঙ্কার জনগণের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই এখনো রাজাপাকসাদের ফিরে আসার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ২০২২ সালের বিক্ষোভে অংশ নেওয়া লক্ষণ সান্দারুয়ান বিবিসিকে জানান, “এটা যথেষ্ট খারাপ যে গণবিক্ষোভের পর যারা বিতাড়িত হয়েছিল তারা এখনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।” এই প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, বিশেষ করে রাজাপাকসা পরিবারের বিরুদ্ধে থাকা দুর্নীতির অভিযোগ এবং অর্থনৈতিক সংকটের দায়।

এক গ্রামবাসী বিবিসি সিংহলাকে জানান, “আমি কখনই নামাল রাজাপাকসাকে ভোট দেব না। আমরা যে কষ্টের সময় পার করেছি, সেটি হয়েছে রাজাপাকসা পরিবারের কারণেই।”

শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ: রাজাপাকসাদের প্রত্যাবর্তন সম্ভব?

রাজাপাকসা পরিবার একসময় শ্রীলঙ্কার জনগণের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বিক্ষোভের কারণে তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়। এরপরও নামাল রাজাপাকসা এবং তার পরিবার রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নামালের লক্ষ্য শুধু এবারের নির্বাচন নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে তিনি সামনে এগিয়ে যেতে চাইছেন। অধ্যাপক জয়দেব উয়াঙ্গোদার মতে, নামালের আসল লক্ষ্য ২০২৯ সালের নির্বাচন, যেখানে তিনি হয়তো পুরোপুরি শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মাঝেও শ্রীলঙ্কার জনগণকে বেছে নিতে হবে নতুন নেতৃত্ব বা পুরনো শক্তিশালী পরিবারের মধ্যে কার ওপর তারা আস্থা রাখতে চায়।

আরও পড়তে পারেন