বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের শ্বেতপত্রে দুর্নীতির একটি ব্যাপক চিত্র উঠে এসেছে।
শ্বেতপত্র অনুসারে, গত ১৫ বছরে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে।
দুর্নীতি ঘটেছে ২৮টি পদ্ধতিতে, যা দেশের অর্থনীতিকে ভঙ্গুর করে তুলেছে।
কমিটি বলছে, এই বিশাল অর্থ পাচারের ফলে দেশের সাধারণ জনগণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
দুর্নীতির শীর্ষ খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকিং, অবকাঠামো, জ্বালানি এবং তথ্যপ্রযুক্তি।
মেগা প্রকল্পে খরচের গড় বৃদ্ধি ছিল ৭০ শতাংশ, যা দুর্নীতির মাত্রা আরও প্রকট করেছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পগুলো শেষ করতে গড়ে পাঁচ বছরের বেশি সময় লেগেছে।
প্রকল্প খাতে দুর্নীতির কারণে ১৪ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার নষ্ট হয়েছে বলে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের সমস্যাকে গভীরতর করেছে।
দেশের ব্যাংকিং খাতে সৃষ্ট মন্দ ঋণ দিয়ে ১৪টি মেট্রোরেল বা ২৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত।
এছাড়া ধারাবাহিক ঋণ খেলাপ এবং কেলেঙ্কারিগুলো আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করেছে।
উৎপাদনশীল খাত থেকে পুঁজি সরিয়ে নেওয়া দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করেছে।
শ্বেতপত্রে আরও বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতেও দুর্নীতি ও ভুয়া বরাদ্দের কারণে লাখ লাখ মানুষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
এছাড়া জলবায়ু তহবিলেও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
শ্বেতপত্রে দাবি করা হয়েছে, বড় প্রকল্পগুলোতে বাজেট বৃদ্ধির জন্য জমির মূল্য এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে।
কমিটি বলেছে, ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাজেটের ৪০ শতাংশ অর্থই লুটপাট হয়েছে।
এছাড়া কর অব্যাহতির কারণে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বাজেট বাড়ানো সম্ভব হয়নি বলে উল্লেখ করেছে শ্বেতপত্র।
কমিটি বলছে, কর অব্যাহতি অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ এবং স্বাস্থ্য বাজেট তিনগুণ করা যেত।
চোরতন্ত্রের বর্ণনা: রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ীদের জোট
শ্বেতপত্রে বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে ‘‘চামচা পুঁজিবাদ’’ থেকে ‘‘চোরতন্ত্রে’’ উত্তরণের কথা বলা হয়েছে।
কমিটির মতে, এই চোরতন্ত্রে রাজনীতিক, আমলা এবং ব্যবসায়ীদের একটি শক্তিশালী জোট তৈরি হয়।
কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আইনসভা, বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ সবাই চোরতন্ত্রের অংশ হয়ে পড়েছিল।’’
তিনি বলেন, ‘‘মূলত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনই চোরতন্ত্রের এই বিষবৃক্ষ তৈরি করেছে।’’
দুর্নীতির মূলে ছিলেন সামরিক এবং বেসামরিক আমলারা বলে শুনানিতে মত এসেছে।
শ্বেতপত্রে কোনো ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করলেও চুরির প্রক্রিয়ার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
কমিটির মতে, নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করে একটি অলিগার্কি গোষ্ঠী দেশকে লুটপাটের পথে ঠেলে দিয়েছে।
এই চক্রটি নীতি তৈরি এবং বাস্তবায়নের প্রায় প্রতিটি স্তরে সক্রিয় ছিল।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বলছে, তারা চোর ধরা নয় বরং চুরির প্রক্রিয়া খুঁজে বের করার কাজ করেছে।
দুর্নীতির ধরন সম্পর্কে আরও জানতে কমিটি দুদক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গোয়েন্দা শাখায় যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আমাদের কাজ চোর ধরা নয়, বরং চুরির বর্ণনা দেওয়া।’’
কমিটির আরেক সদস্য বলেছেন, ‘‘বিদ্যুৎ খাতে নীতি করেই দুর্নীতির পথ সুগম করা হয়েছে।’’
তারা আরও দাবি করেছেন, দুর্নীতির বিপুল অর্থ পাচার দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিদ্যুৎ ও অভিবাসন খাতের অনিয়ম
শ্বেতপত্রে বিদ্যুৎ খাতকে দুর্নীতির অন্যতম শীর্ষ ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে বলে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর মধ্যে ১০ শতাংশ, অর্থাৎ তিন বিলিয়ন ডলার, অবৈধ লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
কমিটির সদস্য ড. ম. তামিম বলেন, ‘‘বিদ্যুৎ খাতে দায়মুক্তির বিধান করে দুর্নীতির দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘নীতি প্রণয়ন করেই দুর্নীতির পথ সুগম করা হয়েছে।’’
বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত উপাদান যোগ করা, জমির দাম বাড়িয়ে দেখানো এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে হেরফের করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতে এই দুর্নীতি সরাসরি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করেছে।
অভিবাসন খাতেও বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, গত এক দশকে অভিবাসন খাত থেকে সাড়ে তের লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
হুন্ডির মাধ্যমে এই বিপুল অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে ভিসা ক্রয়ের নামে এই অর্থ বিদেশে পাঠানো হয়েছে।
এ অর্থ দিয়ে মতিঝিল-উত্তরা মেট্রোরেল প্রকল্পের চারগুণ ব্যয় করা যেত বলে দাবি করা হয়েছে।
শ্বেতপত্রে আরও বলা হয়েছে, সিন্ডিকেট ও অনৈতিক রিক্রুটমেন্ট অভিবাসী কর্মীদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
রেমিট্যান্স থেকে দেশ বঞ্চিত হয়েছে এবং প্রকৃত অভিবাসীরা আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে।
কমিটি বলেছে, ‘‘অভিবাসন খাতের অনিয়ম অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে সীমিত করে দিয়েছে।’’
এই খাতে দুর্নীতির কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এলডিসি উত্তরণ ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা
শ্বেতপত্রে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
কমিটি বলেছে, ‘‘২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের বিকল্প নেই।’’
এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষত গার্মেন্ট খাতের জন্য এটি বড় ধরনের আর্থিক চাপ তৈরি করতে পারে।
জাতিসংঘের ২০২৪ সালের মূল্যায়নে বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণের সব মানদণ্ড পূরণ করেছে।
মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মানদণ্ডে বাংলাদেশ উত্তীর্ণ হয়েছে।
তবে শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, এলডিসি উত্তরণের জন্য সরকারের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আগামী ছয় মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’’
তিনি বাজেট পরিকল্পনা, মূল্যস্ফীতি এবং মুদ্রার মান নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
কমিটি বলেছে, ‘‘অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নির্দেশনা নিয়ে একটি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।’’
ন্যূনতম দুই বছর মেয়াদী পরিকল্পনা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে সহায়ক হবে।
কমিটি আরও বলেছে, ‘‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে অর্থনৈতিক সংস্কার ঝুঁকিতে পড়বে।’’
শ্বেতপত্রে সরকারকে আগামী ছয় মাসের পাশাপাশি মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনার জন্য দ্রুত কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।