বড় ধরনের পতনে ঢাকার শেয়ারবাজারের সূচক ৭২ পয়েন্ট কমেছে
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে আস্থাহীনতার কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। লোকসানে থাকা অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে শেয়ারবাজার ছাড়ছেন।
এই পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারে টানা দরপতন অব্যাহত রয়েছে। আজ বুধবার, দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৭২ পয়েন্ট কমে গেছে। যা প্রায় আড়াই শতাংশের সমান। এর ফলে ডিএসইএক্স সূচকটি ৫,১৭০ পয়েন্টে নেমে এসেছে।
অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচকও একই ধরণের পতনের মুখে পড়েছে। সিএসই সার্বিক সূচকটি আজ ১২১ পয়েন্ট বা ১ শতাংশ কমেছে।
বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট
শেয়ারবাজারে আস্থার অভাব এখন বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে বিদ্যমান অর্থের চেয়ে আস্থার সংকটই বেশি প্রকট বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি থাকার ফলে শেয়ারবাজারে নতুন বিনিয়োগ আসছে না। বাজারে অর্থ থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
এমনকি অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে দিলেও সেই অর্থ তুলে নিচ্ছেন না। তারা বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবে টাকা অলস অবস্থায় রেখে দিচ্ছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, বিনিয়োগকারীরা বাজারে পুনরায় বিনিয়োগ করা নিয়ে শঙ্কিত।
দরপতনের কারণ
শেয়ারবাজারে চলমান দরপতনের পেছনে কয়েকটি বিষয় কাজ করছে। একদিকে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের উদ্যোগগুলো এখনও কার্যকর না হওয়ায় স্বল্পমেয়াদে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্রোকারেজ হাউসের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, শেয়ারবাজারে পুনর্গঠিত বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তবে সেগুলোর সুফল দেখা দিতে সময় লাগবে।
তারা বলেন, বিএসইসির নেওয়া পদক্ষেপগুলো দীর্ঘমেয়াদে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, তবে স্বল্পমেয়াদে এমন কোনো পদক্ষেপ নেই যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিষ্ক্রিয়তা
শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণও অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে শেয়ারবাজারে নতুন বিনিয়োগ আসছে না।
মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর বেশিরভাগই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে বাজারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকেও বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। ফলে বাজারে ক্রেতার তুলনায় বিক্রেতার সংখ্যা বেড়েছে।
এই কারণে বাজারে ক্রমাগত দরপতন অব্যাহত রয়েছে।
বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কমছে
বিও হিসাবের সংখ্যা দিয়ে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণের অবস্থা বোঝা যায়। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, চলতি মাসে সাড়ে ছয় হাজার বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজার ছেড়ে দিয়েছেন।
তারা তাদের বিও হিসাবে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন, ফলে এই বিও হিসাবগুলো এখন শেয়ারশূন্য অবস্থায় রয়েছে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শেয়ারশূন্য বিও হিসাব ছিল ৩ লাখ ১৮ হাজার ৪১৪টি। তবে ২২ অক্টোবর তা বেড়ে ৩ লাখ ২৪ হাজার ৯২০টিতে পৌঁছেছে।
অর্থাৎ, ১ থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ১৪ কার্যদিবসে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি বিনিয়োগকারী তাদের বিও হিসাব শেয়ারশূন্য করে ফেলেছেন।
লেনদেনের পরিমাণও কমেছে
শেয়ারবাজারে লেনদেনের পরিমাণও হ্রাস পেয়েছে। ঢাকার শেয়ারবাজারে আজকের লেনদেনের পরিমাণ ৩২২ কোটি টাকা, যা আগের দিনের তুলনায় ৩৬ কোটি টাকা কম।
অপরদিকে, চট্টগ্রামের শেয়ারবাজারে লেনদেনের পরিমাণ আগের দিনের তুলনায় ১১ কোটি টাকা কমে ৩ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
বাজার পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা
বাজারের এই পতনমুখী ধারা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘বাজার এখন অনেক নিচে নেমে গেছে। ফলে অনেক শেয়ার এখন বিনিয়োগযোগ্য অবস্থায় চলে এসেছে।’
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীরা যদি এখন বাজারে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসেন, তবে বাজার দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
আস্থাহীনতার প্রভাব
বাজারসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে বাজারে অনিয়ম চলতে থাকায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ভেঙে গেছে।
বাজারে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, এটি একটি কঠিন কাজ। বাজারের সকল পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে এবং ধীরে ধীরে আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘বাজারে বিভিন্ন অনিয়ম দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। তাই বাজারের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বাজারবান্ধব পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এখনও বাজারের সব পক্ষকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয়নি।
এ কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে।
বাজারে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের প্রয়োজন
বিশেষজ্ঞদের মতে, শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। স্বল্পমেয়াদে কোনো পদক্ষেপের মাধ্যমে বাজারে দ্রুত পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।
তারা পরামর্শ দিচ্ছেন, বাজারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোকে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় করতে হবে।
এছাড়া, বাজারে নতুন বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্যও উদ্যোগ নিতে হবে।
সমন্বিত পদক্ষেপের গুরুত্ব
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
বাজারে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা আনতে হবে।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হলে তাদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে যোগাযোগ রাখতে হবে এবং বাজার সম্পর্কে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আস্থা পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে সম্পন্ন হবে, তবে এটি সফল হলে শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে পারে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
শেয়ারবাজারে বর্তমানে যে আস্থাহীনতার অবস্থা বিরাজ করছে, তা দূর করতে বাজার সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে।
বাজারে চলমান এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে এবং নতুন বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
শেয়ারবাজারে আস্থা পুনরুদ্ধার করা না গেলে, বাজারে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা আনা কঠিন হতে পারে।