নিরাপত্তার কারণে তড়িঘড়ি করে ভারতে গেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও জাতীয় দিবস বাতিল নিয়ে বাংলাদেশে অস্থিরতা
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন বলে নিশ্চিত করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আজ বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল এক প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য জানান। নিরাপত্তার কারণে অল্প সময়ের নোটিশে তিনি ভারতে গেছেন এবং এখনো সেখানেই আছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর থেকে তাঁর সঠিক অবস্থান নিয়ে জল্পনা চলছিল। কেউ বলছিলেন, তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে আছেন, আবার কেউ বলছিলেন, ভারত সরকার তাঁকে ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ ইস্যু করেছে। তবে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বক্তব্যের মাধ্যমে শেখ হাসিনার অবস্থান স্পষ্ট হলো।
নিরাপত্তার কারণে তড়িঘড়ি করে ভারত যাত্রা
মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল জানিয়েছেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নিরাপত্তার কারণে অল্প সময়ের নোটিশে শেখ হাসিনা ভারতে চলে এসেছেন। যদিও বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি, তবে বোঝা যাচ্ছে যে, পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা থেকেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্দোলনের জেরে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ভারতের পক্ষ থেকে এটিকে সরাসরি নিরাপত্তা ঝুঁকির সঙ্গে যুক্ত করে মন্তব্য করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি ও জাতীয় দিবস বাতিল
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। তাঁদের আগামী ১৮ নভেম্বরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এবং জাতীয় দিবস বাতিলের সিদ্ধান্তের ফলে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ এবং ১৭ মার্চসহ আটটি জাতীয় দিবস বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
ভিসাপ্রক্রিয়া স্থগিত ও ভারতীয় প্রতিক্রিয়া
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর থেকে বাংলাদেশিদের জন্য ভারতের ভিসাপ্রক্রিয়া স্বাভাবিক হয়নি। এর ফলে উভয় দেশের নাগরিকদের যাতায়াতে অসুবিধা দেখা দিয়েছে।
সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে জয়সোয়াল বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি উন্নতি হলে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ভিসাপ্রক্রিয়াও স্বাভাবিক হবে। এখন শুধুমাত্র জরুরি প্রয়োজন এবং চিকিৎসা–সংক্রান্ত ক্ষেত্রে সীমিত আকারে ভিসা দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের বিবৃতি
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ এবং দুর্গাপূজার মণ্ডপে ভাঙচুরের ঘটনায় ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল। ভারতের পক্ষ থেকে এই ঘটনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল এবং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল।
মুখপাত্র জয়সোয়াল বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং সেটি পালনের দায়িত্ব তাদের।
শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ
শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিয়ে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েক মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিক্ষোভ, এবং বিভিন্ন আন্দোলন দেশের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ হাসিনার দেশত্যাগের সময় থেকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে থাকে। তাঁর ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকে সরকারবিরোধী শক্তিগুলো তাঁকে এবং তাঁর দলকে আরও বেশি সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে।
ভারতের নীরবতা: রাজনৈতিক শিষ্টাচার নাকি কৌশল?
ভারতীয় মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশদ কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি শুধু বলেছেন যে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের পরিস্থিতি নজরে রেখেছে এবং কোনো রকমের অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তবে সরাসরি মন্তব্য না করার এই প্রবণতা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও দেখা হতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের এই নীরবতা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যুতে সরাসরি হস্তক্ষেপ না করে, ভারতের পক্ষ থেকে অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ ভূমিকা নেওয়া হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চয়তা দেওয়ার কারণে ভারত সরকার তাঁর প্রতি সহানুভূতির বার্তা দিচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।
ভিসাপ্রক্রিয়া স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষা
বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ভিসাপ্রক্রিয়া স্বাভাবিক করার ব্যাপারে আশাবাদী ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মুখপাত্র জয়সোয়াল বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হলে এবং পরিস্থিতি অনুকূল হলে ভিসাপ্রক্রিয়া উন্নত হবে।’ আপাতত সীমিত আকারে ভিসা প্রদান করা হচ্ছে, বিশেষ করে জরুরি প্রয়োজন এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে।
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে ভারতের উদ্বেগ
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ এবং দুর্গাপূজার মণ্ডপে ভাঙচুরের ঘটনায় ভারতের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘আমরা আশা করছি, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে।’
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের ঘটনায় ভারত সরকার থেকে নিয়মিত প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়, কারণ দেশটির নিজস্ব অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে।
ভবিষ্যৎ কী? পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে?
শেখ হাসিনার ভারত অবস্থান এবং তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর বাংলাদেশের রাজনীতি ও আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, সেটি এখন দেখার বিষয়। দেশের সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা পরিস্থিতির উন্নতি এবং অস্থিরতা নিরসনের অপেক্ষায় রয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর অবস্থান, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, এবং জাতীয় দিবস বাতিলের মতো সিদ্ধান্তগুলো দেশের রাজনৈতিক সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে নতুন করে সংলাপের আহ্বান উঠছে এবং রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও আলোচনা শুরুর প্রস্তাব আসছে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অস্থিরতা মোকাবিলার পথে কিভাবে এগোবে, এবং শেখ হাসিনা আবার কবে দেশে ফিরে আসবেন, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
এখন দেখার বিষয়, কিভাবে পরিস্থিতির সমাধান হবে এবং বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে মোড় নেবে।