দলটির নেতৃত্ব সংকটে, অতীতের ১৯৭৫ ও বর্তমানের ঘটনার মধ্যে মিল খুঁজছেন বিশ্লেষকরা
পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ চরম সংকটে পড়েছে। দলটির বর্তমান পরিস্থিতি ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর দলের যে অবস্থা হয়েছিল, সেই সংকটের সাথে তুলনা করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ‘পতন ও সংকটের ধরন ভিন্ন’ হলেও দলটির বর্তমান অবস্থা অনেকটাই ‘ছন্নছাড়া’।
গত জুলাই এবং অগাস্ট মাসে তীব্র ছাত্র আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর দলটির অনেক শীর্ষ নেতাই আত্মগোপনে চলে গেছেন। অনেকে আটক হয়ে কারাগারে আছেন এবং বাকিরা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন বলে জানা গেছে। ফলে, দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। এমনকি রাজধানী ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও আন্দোলনকারীদের হামলার পর থেকে তছনছ অবস্থায় পড়ে আছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্টের ঘটনার পর দলের যে অবস্থা হয়েছিল, বর্তমানে দলটি ঠিক সেই ধরনের এক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে, এবারের সংকটের ধরন আলাদা হলেও ফলাফল একই রকম ভয়াবহ।
নেতৃত্বহীন অবস্থায় আওয়ামী লীগ
দলটির শীর্ষ নেতারা এখন আত্মগোপনে রয়েছেন এবং কেউ কেউ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছেন। দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ও অফিসে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি দলটির প্রধান কার্যালয়ও আন্দোলনকারীদের হাতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছে। গোপালগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন।
দলের প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর থেকে তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় গণমাধ্যমে একাধিকবার ভিডিও বার্তা দিয়েছেন, তবে দলটির অন্য নেতাদের থেকে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। জয় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমার মনে হয় এখানেই শেষ। আমার পরিবার এবং আমি – আমাদের যথেষ্ট হয়েছে।” তবে পরবর্তী সময়ে তিনি বলেন, “অবশ্যই তিনি (শেখ হাসিনা) বাংলাদেশে ফিরবেন, যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে।”
১৯৭৫ সালের ঘটনার স্মৃতি ফিরে আসছে
১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্টে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। সেই ঘটনার পর আওয়ামী লীগ চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। দলটির তখনকার শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে চলে যান এবং অনেক নেতা দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক ছিলেন। তৎকালীন সেনা অভ্যুত্থানে দলের নেতৃত্বহীন অবস্থায় খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন এবং শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর পরই দলটি কার্যত ভেঙে পড়ে।
এবারের সংকটও অনেকটা সেরকমই। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে দলটি পুরোপুরি নেতৃত্বহীন হয়ে পড়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৭৫ সালের পরের মতোই এবারও আওয়ামী লীগ ছন্নছাড়া অবস্থায় পড়েছে এবং দলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
আটক ও আত্মগোপনে নেতারা
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে দলের সিনিয়র নেতাদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন। গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ অনেক নেতাই ভারতে গেছেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমসহ অনেক নেতাই ভারতে বা অন্য কোনো দেশে পালিয়ে গেছেন। তবে, নিরপেক্ষ কোনো সূত্র থেকে এ তথ্যের সত্যতা যাচাই করা যায়নি।
এদিকে, দলটির বহু নেতা ও সাবেক মন্ত্রী, এমপি পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান, সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, দীপু মনি, সালমান এফ রহমানসহ আরো অনেকে। ফলে দলটি সাংগঠনিকভাবে পুরোপুরি অচল হয়ে পড়েছে।
গোপালগঞ্জে বিক্ষোভ ও দলীয় কোন্দল
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা গোপালগঞ্জে কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। তারা শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করলেও দলের নেতারা প্রকাশ্যে কোনো ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হননি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বশূন্যতার কারণে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে। অনেকে দলীয় কোন্দলের কারণে সংগঠনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। দলটির একাধিক তৃণমূল নেতা জানান, তারা এখন উদ্বেগ ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন এবং গণমাধ্যমে কথা বলার সময় নিজেদের নাম প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছেন।
শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভূমিকা
শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় দলটির মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন। তিনি কয়েকবার ভিডিও বার্তা দিয়ে দলীয় অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। তবে, দলের ভেতরে এবং বাইরে অনেকে মনে করেন যে, জয় দলের শীর্ষ নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ করতে পারবেন না। তার বক্তব্যে দলীয় সংকটের সমাধানের কোনো ইঙ্গিত নেই বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।
নেতৃত্বে পরিবর্তনের সম্ভাবনা
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। তবে, এ ব্যাপারে দলটির কোনো শীর্ষ নেতার কাছ থেকে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অনেকেই মনে করছেন, নেতৃত্বে পরিবর্তনের মাধ্যমে দলটি আবারও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করবে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, দলটির বর্তমান সংকট কেবল নেতৃত্ব পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাধান হবে না। দলটির ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিভেদ এবং ক্ষমতার লড়াইও সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে।
১৯৭৫ ও ২০২৪: দুটি ঘটনার মধ্যে মিল ও অমিল
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ এবং অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন উভয়েই মনে করেন যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্টের ঘটনার পর আওয়ামী লীগ যেমন ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছিল, বর্তমানের সংকটও প্রায় একই রকম। তবে, এবারের সংকটের ধরন ভিন্ন।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল, যা ছিল একটি রক্তাক্ত ও সহিংস ঘটনা। এবারের ঘটনাটি এতটা রক্তাক্ত না হলেও এর রাজনৈতিক প্রভাব গভীর।
অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলছেন, “দুটি ঘটনাই দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে।”
১৯৭৬ সালের পুনর্গঠন ও বর্তমান সংকট
১৯৭৫ সালের ঘটনার পর দলটি পুনর্গঠিত হওয়ার সুযোগ পায় ১৯৭৬ সালে, যখন রাজনৈতিক দলগুলো নিবন্ধনের সুযোগ দেয়া হয়। দলটির ভেতরে তখন নানা ধরনের বিভেদ দেখা দিয়েছিল এবং দলটি একাধিক অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। শেখ মুজিবের পর দলের মধ্যে নতুন নেতৃত্ব তৈরি না হওয়ায় দলটি নেতৃত্বহীনতার সমস্যায় পড়েছিল।
আওয়ামী লীগের বর্তমান সংকটেও একই ধরনের নেতৃত্ব সংকট দেখা যাচ্ছে। দলটি শীর্ষ নেতৃত্বের অভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে পারছে না এবং দলের তৃণমূল পর্যায়ে হতাশা বাড়ছে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
দলটি বর্তমান সংকট থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসবে, তা নিয়ে বিশ্লেষকরা ভিন্নমত পোষণ করছেন। কেউ মনে করছেন যে, নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে দলটি পুনর্গঠিত হতে পারে। আবার কেউ কেউ বলছেন, দলের ভেতরের দীর্ঘদিনের বিভেদ এবং ক্ষমতার লড়াইয়ের কারণে সংকট থেকে বের হওয়া কঠিন হবে।
আওয়ামী লীগের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দলকে সাংগঠনিকভাবে পুনরায় গড়ে তোলা এবং তৃণমূল কর্মীদের আস্থা ফিরে পাওয়া। নেতৃত্বের অভাব এবং দলীয় কোন্দলের কারণে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কঠিন হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
সঙ্কট নিরসনে কীভাবে এগোতে পারে আওয়ামী লীগ?
দলীয় ভেতরে চলমান সংকট নিরসনের জন্য আওয়ামী লীগকে দ্রুত নেতৃত্বের পরিবর্তন আনতে হতে পারে। দলটির ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, সংকটকালে নেতৃত্বের পরিবর্তন দলকে শক্তিশালী করে তুলেছে। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দলের পুনর্গঠনে সফল হয়েছিল। এবারও এমন কিছু হতে পারে বলে অনেকে আশাবাদী।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দলের মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে নতুন কৌশল নির্ধারণ করা জরুরি। আওয়ামী লীগের ভেতরে গঠনতান্ত্রিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস এবং তৃণমূল নেতাদের কার্যকরীভাবে সম্পৃক্ত করা দলের সংকট নিরসনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, দলটির সামনে চ্যালেঞ্জগুলো খুবই কঠিন। বর্তমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নতুন কৌশল এবং একক নেতৃত্বের প্রয়োজন হবে, যা শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে কতটা কার্যকর হবে তা সময়ই বলে দেবে।
সংকট নিরসনে নেতৃত্ব ও সংগঠনের সঠিক পুনর্গঠন করতে পারলেই দলটি পুনরায় দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়াতে সক্ষম হবে। তবে, এর জন্য দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং দলীয় ঐক্য প্রয়োজন হবে।