, ,

শেখ হাসিনার গোপন ফ্লাইট: কীভাবে এড়ানো হয়েছিল রাডার

২০২৪ সালের ৫ই অগাস্ট, একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মোড়ের দিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপনে দেশ ত্যাগ করেন, যা অনেকের কাছে কেবল গুজব ছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এটি একটি বিতর্কিত ঘটনা হিসেবে সামনে আসে। দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র দ্য ডেইলি স্টার এর প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, শেখ হাসিনার পালিয়ে যাবার সময় তার ফ্লাইট রাডারের বাইরে রাখা হয়েছিল, একটি প্রশিক্ষণ ফ্লাইট হিসেবে সাজিয়ে। এটি দেশীয় রাজনীতিতে এক বড় ধরনের রহস্য তৈরি করেছে।

শেখ হাসিনার ফ্লাইট যেভাবে সাজানো হয়েছিল

দ্য ডেইলি স্টার এর প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হয়েছে, কারণ এতে বলা হয়, ৫ই অগাস্ট বিকেল ৩টা ০৯ মিনিটে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান বাহিনীর একটি ট্রান্সপোর্টার বিমান উড্ডয়ন করে। বিমানটি একটি লকহিড সি-১৩০ হারকিউলিস, যা সাধারণত সামরিক ও লজিস্টিক ফ্লাইট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

এই ফ্লাইটটিকে “প্রশিক্ষণ ফ্লাইট” হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিশেষ একটি ফ্লাইট। বিমানটি বঙ্গবন্ধু এয়ারবেস থেকে উড্ডয়ন করলেও, প্রথমে এর অবস্থান এবং গতিপথ সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল না। শেখ হাসিনার ফ্লাইটটির ট্রান্সপন্ডার (বিমানটির অবস্থান নির্ণায়ক ডিভাইস) বন্ধ রাখা হয়েছিল, যা বিমানটির অবস্থান রাডারে ধরা না পড়ার একটি কৌশল ছিল।

ট্রান্সপন্ডার বন্ধের পেছনে কারণ

ট্রান্সপন্ডার হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ, যা বিমানটির অবস্থান, গতি এবং উচ্চতা সংক্রান্ত তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের কাছে প্রেরণ করে। এটি চালু না থাকলে বিমানটির গতিপথ নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, বিশেষ করে যদি সেটি কোনো সামরিক বা সুরক্ষিত আকাশসীমার মধ্যে না থাকে। দ্য ডেইলি স্টার এর প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিমানটি যখন বাংলাদেশের আকাশসীমা পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় আকাশসীমার কাছাকাছি পৌঁছায়, তখন ট্রান্সপন্ডার চালু করা হয়। কিন্তু এর আগে পুরো ফ্লাইট জুড়েই বিমানটির গতিপথ রাডারের বাইরে রাখা হয়েছিল।

এই ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে, বিশেষ করে বাংলাদেশে, যেখানে শেখ হাসিনার আকস্মিক দেশত্যাগ ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল সব মহলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। রাজনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা এই ধরনের পরিকল্পনা ও পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং একে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের অংশ হিসেবে দেখছেন।

এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের ভূমিকা

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) এর সাথে ফ্লাইটের একটি ফ্লাইট প্রগ্রেস স্ট্রিপের কপি সংগ্রহ করা হয়েছে, যেখানে বিমানের গতিপথ ও অন্যান্য তথ্য উল্লেখ ছিল। ফ্লাইট প্রগ্রেস স্ট্রিপ হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, যা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা আকাশপথে থাকা বিভিন্ন বিমানের গতিপথ নির্ধারণ করতে ব্যবহার করেন, যেন বিমানগুলো আকাশে সংঘর্ষের কবলে না পড়ে। এই তথ্য থেকে দেখা যায়, শেখ হাসিনার বিমানটি বঙ্গবন্ধু এয়ারবেস থেকে উড্ডয়ন করার পরে প্রথমে বাংলাদেশের আকাশসীমার মধ্যে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, কিন্তু আকাশসীমার বাইরে চলে যাওয়ার পরেই এর ট্রান্সপন্ডার চালু করা হয়।

বিমানটি যখন বাংলাদেশ-ভারত আকাশসীমার “বেমক” নামক ওয়েপয়েন্টে পৌঁছায়, তখন এটিসি-এর সাথে এর প্রথম কার্যকরী যোগাযোগ শুরু হয়। ট্রান্সপন্ডার চালু হওয়ার পরে, বিমানটি কলকাতা বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের রাডারে আসে এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানানো হয় যে এটি একটি প্রশিক্ষণ ফ্লাইট হিসেবে আসছে।

রাজনৈতিক পরিণতি ও প্রশ্ন

এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কিভাবে একটি সামরিক প্রশিক্ষণ ফ্লাইটে প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যেতে পারেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি শুধুমাত্র একটি গোপন মিশন ছিল না, বরং এটি ছিল পরিকল্পিত রাজনৈতিক পদক্ষেপ, যাতে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী দেশ ত্যাগ করতে পারেন।

সাবেক মন্ত্রী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলেন, “শেখ হাসিনার দেশত্যাগ বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যতের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। এটি প্রমাণ করে যে, সরকার পতনের আশঙ্কায় তিনি কোনো বিকল্প পথ খুঁজে নিয়েছিলেন। এটি দেশের রাজনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতা এবং ক্ষমতাসীনদের ওপর অনাস্থার পরিচায়ক।”

সরকারের নীরবতা

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এখনো এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য আসেনি। সরকারের নীরবতা অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। কেন শেখ হাসিনার ফ্লাইটকে একটি গোপন প্রশিক্ষণ ফ্লাইট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল? কেন ট্রান্সপন্ডার বন্ধ রাখা হয়েছিল এবং কেন বিমানটি রাডার থেকে আড়াল করা হয়েছিল?

অন্যদিকে, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী থেকেও এই ঘটনায় কোনো সুনির্দিষ্ট বিবৃতি দেওয়া হয়নি। যদিও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে যে, এটি একটি নিরাপত্তা মিশনের অংশ ছিল এবং প্রধানমন্ত্রীকে সুরক্ষা দিতেই এই গোপন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল।

গণমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া

এ ঘটনা গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে একটি তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সাংবাদিক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “শেখ হাসিনার এভাবে দেশত্যাগ করা তার ক্ষমতার পতনের ইঙ্গিত বহন করে। এটা শুধু একটি রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং এর পেছনে বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সমীকরণ কাজ করেছে।”

দ্য ডেইলি স্টার এর রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে বিশ্লেষণ শুরু হয়। কেউ কেউ এই ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক পালানোর’ উদাহরণ হিসেবে দেখছেন, যেখানে রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে গোপনে দেশ ত্যাগ করেন।

ভবিষ্যতের রাজনীতির দিকে নজর

শেখ হাসিনার এই ফ্লাইট এবং রাডারের বাইরে রাখা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। এটি কেবল একটি ঘটনা নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর এর গভীর প্রভাব পড়তে পারে। বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল এই ঘটনার পরে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে, কারণ শেখ হাসিনার প্রস্থান দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং এর সাথে সম্পর্কিত পরিস্থিতি আগামী বছরগুলোর রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হয়েছে, যেখানে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে নেতৃত্বের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হতে পারে।

শেখ হাসিনার গোপন ফ্লাইট এবং এর সাথে সম্পর্কিত রহস্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এর পরিণতি কী হবে এবং দেশের রাজনীতিতে এর প্রভাব কতদূর পৌঁছাবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এটুকু বলা যায়, এই ঘটনা শুধু একটি ব্যক্তিগত দেশত্যাগ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতার প্রতিফলন, যা এখন আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।

আরও পড়তে পারেন