বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রভাব এবং রাজনৈতিক সুবিধাভোগীদের সমর্থনে কয়েকটি বড় শিল্পগোষ্ঠী শিল্প-বাণিজ্যে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব শিল্পগোষ্ঠী এখন ‘অলিগার্ক’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পদচ্যুত সরকারের ছত্রছায়ায় থাকা এসব ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নতুন করে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। ক্ষমতা থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের অপসারণের পর এই শিল্পগোষ্ঠীগুলোর বিপুল সম্পদ এবং ব্যাংকিং খাতে প্রভাবের বিষয়টি সামনে এসেছে।
এগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ এবং চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপ। বেক্সিমকোর মালিক এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে শেয়ারবাজার কারসাজি, বিপুল পরিমাণ ঋণ এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। একই অভিযোগ উঠেছে এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে, যিনি ইসলামী ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংক দখলের অভিযোগেও অভিযুক্ত। এই দুই শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নেয়া সাম্প্রতিক কঠোর পদক্ষেপ এবং তাদের ভবিষ্যত এখন দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অঙ্গনে বড় আলোচনার বিষয়।
বেক্সিমকো এবং এস আলমের ব্যবসা সাম্রাজ্য
বেক্সিমকো গ্রুপের অধীনে রয়েছে তৈরি পোশাক, সিরামিক, ঔষধ, গণমাধ্যমসহ বহু খাতের ব্যবসা। বাংলাদেশের অন্যতম বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী হিসেবে বেক্সিমকোর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক ঋণের সুবিধা নিয়েছে এবং শেয়ারবাজারে কারসাজির মাধ্যমে ব্যাপক সম্পদ অর্জন করেছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি বেক্সিমকোর ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে এবং তাদের প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
অন্যদিকে এস আলম গ্রুপের ব্যবসার বিস্তৃতি বিদ্যুৎ, ইস্পাত, সিমেন্ট, ভোজ্যতেল, চিনি, টেক্সটাইল, মিডিয়া এবং অন্যান্য বহু খাতে। ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকের মালিকানা নিয়ে বিতর্কিত এই শিল্পগোষ্ঠী লক্ষ কোটি টাকার ঋণ এবং বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগেও অভিযুক্ত। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এস আলম গ্রুপ তাদের টিকে থাকার জন্য সরকারের কাছে আইনি এবং আর্থিক সহায়তা চেয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, এলসি বাতিল হওয়ায় আমদানি বন্ধ থাকায় ভোগ্যপণ্যের সংকট দেখা দিতে পারে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার উপর প্রভাব ফেলবে।
অলিগার্কদের বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপ
সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশজুড়ে আর্থিক ও শিল্পখাতে শৃঙ্খলা আনতে ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো এই তথাকথিত অলিগার্কদের সম্পদ ও ব্যবসার ওপর নানামুখী নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। বেক্সিমকো এবং এস আলম গ্রুপের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে, এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অন্যান্য শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে।
অলিগার্কদের নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই গোষ্ঠীগুলি রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল এবং তারা এই প্রভাবকে ব্যবহার করে শিল্পখাতে এক ধরনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। যখন কোনো একক গোষ্ঠী একটি সম্পূর্ণ খাতকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখনই তাদেরকে ‘অলিগার্ক’ বলা হয়।”
শ্রমিক ও অর্থনীতির ওপর প্রভাব
বেক্সিমকো এবং এস আলমের মতো বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলিতে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ করেন। সাম্প্রতিক সংকটের কারণে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ বা সীমিত হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধে ব্যর্থতা দেখা দিয়েছে। এস আলম গ্রুপ সরকারকে সতর্ক করেছে যে, যদি দ্রুত সমস্যার সমাধান না হয়, তবে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিতে পারে, যা দেশের শিল্প এলাকায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া, গাজী গ্রুপের সাতটি প্রতিষ্ঠান ৫ই আগস্টের পর ব্যাপক হামলা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছে, যার ফলে সেখানে প্রায় সাড়ে সাত হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক অস্থিরতাও সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের জীবিকা ঝুঁকির মুখে পড়ছে। বিশেষ করে দেশের তৈরি পোশাক খাত, যা রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান খাত, সেখানেও এ ধরনের অস্থিরতা দেখা দিলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ এবং সরকারের ভূমিকা
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার এই মুহূর্তে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে এবং সেগুলোর মালিকদের শাস্তি নিশ্চিত করতে ব্যস্ত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, “প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখতে হবে দেশের স্বার্থে, কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি যারা দুর্নীতির সাথে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি আরও যোগ করেন যে, কিছু প্রতিষ্ঠান হয়তো সরকারের অধীনে নিয়ে আসা হতে পারে, এবং মালিকানায় পরিবর্তন আনার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে, শিল্পের ক্ষতি না করে এবং শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিয়েই এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হবে বলে তিনি আশ্বস্ত করেন।
শিল্পখাতের সংকট এবং অর্থনৈতিক প্রভাব
বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞের মতে, এই পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “এই গোষ্ঠীগুলোর সম্পদ এবং শিল্পখাতের উপর এত বেশি প্রভাব রয়েছে যে, যদি তারা হঠাৎ করে শিল্প পরিচালনা থেকে বিচ্যুত হয়, তাহলে সেবার মান নেমে যেতে পারে এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”
তবে, অনেকের মতে, এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া জরুরি ছিল, কারণ দীর্ঘদিন ধরে অলিগার্কদের প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অনেকাংশে ব্যাহত হয়েছে। তারা শিল্পখাতের আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এটি আরও ক্ষতিকর হতে পারে।
শিল্পখাতের নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
অলিগার্কদের কারখানা এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ৫ই আগস্টের পর থেকেই এসব প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। সরকার শিল্প প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু তবুও শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যত কী হবে, সেটি এখনও অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেছেন যে, সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে শিল্পখাতের ক্ষতি না করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া।
উপসংহার
বাংলাদেশের শিল্পখাত এবং তথাকথিত ‘অলিগার্ক’দের বিরুদ্ধে নেওয়া বর্তমান পদক্ষেপগুলো দেশের অর্থনীতি এবং সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হবে। সরকার একদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে, অন্যদিকে শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মসংস্থান এবং দেশের অর্থনীতিকে সুরক্ষা দিতে উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু এই সংকট মোকাবিলা কতটা দক্ষতার সাথে করা যাবে, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।