ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন পর জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’-এর প্রকাশ্যে আসার ঘটনা দেশব্যাপী রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তপ্ত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতির পরিচয় সামনে আসার পর থেকে শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক মহলে তুমুল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আবু সাদিক কায়েম নামের একজন শিক্ষার্থী নিজেকে ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা বলে মনে করছেন অনেকে।
শিবিরের ইতিহাস ও পরিপ্রেক্ষিত
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী এবং তার ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের ভূমিকা বরাবরই বিতর্কিত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। সেই সময় জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ছিল ‘ইসলামী ছাত্রসংঘ’। স্বাধীনতার পরে জামায়াত ও ছাত্রসংঘ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে ১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’ নামে পুনর্গঠিত হয়। আশির দশকে এ সংগঠনটি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের প্রাচীনতম এবং সর্বাধিক রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আশির দশক থেকেই শিবিরের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর শিবিরের বিরুদ্ধে ঢাবির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা একজোট হয়ে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা হত্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও শিবিরের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
রাজনৈতিক পরিবর্তন ও শিবিরের আত্মপ্রকাশ
গত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের প্রকাশ্য কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং শিবিরের ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে সংগঠনটি আন্ডারগ্রাউন্ড বা গোপন কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল বলে জানা গেছে। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় শিবিরের পুনরায় আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আবু সাদিক কায়েমের শিবিরের সভাপতির পরিচয় প্রকাশ করার ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ।
কায়েম নিজে স্বীকার করেছেন যে, দীর্ঘদিন গোপনে তিনি শিবিরের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তবে তার রাজনৈতিক পরিচয় সামনে আসার পর থেকে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে মনে করছেন। ছাত্রলীগ, ছাত্রদলসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠনগুলো কায়েমের পরিচয় প্রকাশের পর থেকেই শিবিরের পুনরায় কার্যক্রম শুরু নিয়ে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছে।
ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবু সাদিক কায়েমের বক্তব্য
আবু সাদিক কায়েম নিজেই বলেন যে, পরিস্থিতির চাপে পড়েই এতদিন তিনি নিজের রাজনৈতিক পরিচয় গোপন রেখেছিলেন। তিনি বলেন, “আমরা আগেও ছিলাম, শুধু প্রকাশ্যে আসতে পারিনি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের কারণে। তবে এখন রাজনৈতিক বাস্তবতা পাল্টেছে, তাই আমরা প্রকাশ্যে এসেছি।” তিনি আরও দাবি করেন, “আমরা সুস্থধারার রাজনীতি করতে চাই। বাকি সংগঠনগুলোর সঙ্গে আমরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে ক্যাম্পাসে আমাদের কার্যক্রম চালাতে প্রস্তুত।”
এছাড়া তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, বর্তমান প্রশাসনের সঙ্গে ইতোমধ্যে যোগাযোগ করেছেন এবং মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে চাই, কিন্তু এর আগে বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করবো।”
অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের প্রতিক্রিয়া
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল, ছাত্রলীগ এবং বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত তীব্র। ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে শিবিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি, এবং শিবিরের যেকোনো কার্যক্রম বন্ধ রাখার পক্ষে রয়েছি। হঠাৎ করে প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্ত আমাদের বিস্মিত করেছে।” ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেও শিবিরের পুনঃপ্রকাশকে স্বাগত জানানো হয়নি, যদিও সাম্প্রতিক আন্দোলনের ফলে তাদের নিজস্ব অবস্থান কিছুটা দুর্বল হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ সংকট
কায়েমের শিবিরের সভাপতির পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভ্যন্তরে চরম সংকট তৈরি হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী নিজেদেরকে প্রতারিত মনে করছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আরিফ সোহেল বিবিসিকে জানান, “আমরা কখনোই জানতাম না যে, কায়েম শিবিরের সঙ্গে যুক্ত। এ খবর পাওয়ার পর আমরা অস্বস্তিতে পড়েছি।” সমন্বয়কারীদের সঙ্গে শিগগিরই একটি বৈঠক হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন, যেখানে কায়েমের ভবিষ্যত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হয়েছে যে, শিবিরের ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে রাজনীতি চালানোর বিষয়ে কোনো লিখিত নিষেধাজ্ঞা নেই। প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ জানান, “ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ ছিল, এমন কোনো লিখিত দলিল আমরা পাইনি। তবে ছাত্রসংগঠনগুলোর মতামত নিয়ে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবো।” বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শিবিরের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়েছে, তবে এ বিষয়ে শিক্ষার্থী ও অন্য ছাত্রসংগঠনের নেতাদের আপত্তি রয়েছে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
শিবিরের প্রকাশ্যে আসার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে ছাত্ররাজনীতির জোয়ার বইতে শুরু করেছে। ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিবিরের পুনরায় কার্যক্রম শুরু এবং ছাত্রলীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি স্থায়ীভাবে বন্ধ করারও প্রস্তাব উঠেছে, তবে এ নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। প্রশাসন বলছে, সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। অন্যদিকে, শিবিরের প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালানোর সিদ্ধান্ত ছাত্রসমাজের মধ্যে ভিন্নমত সৃষ্টি করেছে, যা ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
এভাবে ছাত্রশিবিরের আত্মপ্রকাশ এবং ক্যাম্পাসে তাদের পুনরায় রাজনীতি করার চেষ্টাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।