বাংলাদেশে অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে হঠাৎ করে শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আইএমএফ-এর ঋণের শর্ত পূরণ এবং রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির কারণেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে এখনও সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি, তবে অর্থনীতিবিদদের ধারণা, অতিরিক্ত এক বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য চাপ বেড়েছে।
২০২৩ সালে আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন দেয়, যার তিনটি কিস্তি ইতোমধ্যে ছাড় হয়েছে।
নতুন কিস্তি ছাড়ের আগে আইএমএফ কঠোর শর্ত দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি।
বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩১ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঘাটতি পূরণ করতে কর বাড়ানোর বিকল্প পথ বেছে নিয়েছে সরকার।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী কর-জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।
অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা গ্রহণে ব্যর্থতার কারণেই এ ধরনের আকস্মিক পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।
তিনি বলেন, “সরকার কর সংগ্রহে সংস্কারমূলক উদ্যোগ না নিয়ে সহজ পথে হাঁটছে, যা সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।”
সরকারি ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, শুল্ক বাড়ানোর ফলে কিছু ক্ষেত্রে রাজস্ব বৃদ্ধি হলেও প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে না।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গত জানুয়ারিতে বলেন, “জরুরি পণ্যের ওপর শুল্ক শূন্য করা হয়েছে, যা ভোক্তাদের কিছুটা স্বস্তি দেবে।”
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়ে যেতে পারে।
আইএমএফের ঋণ শর্তের কারণে সরকার দ্রুত রাজস্ব বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, “এই পদক্ষেপে সরকার জনমনে অস্থিরতা তৈরি করছে, যা রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর হতে পারে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “কর ফাঁকি রোধ এবং সম্পত্তি কর বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ কমানো যেত।”
সরকারি ব্যয় সাশ্রয় এবং উন্নয়ন প্রকল্পে কাটছাঁট করার ঘোষণা দেওয়া হলেও এটি মূল্যস্ফীতি রোধে যথেষ্ট নয়।
কোন কোন পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বেড়েছে?
সরকারের নতুন অধ্যাদেশে শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক এবং আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাতে অধ্যাদেশ কার্যকর হওয়ায় মোবাইল ফোন সেবা, ইন্টারনেট, রেস্তোরাঁর খাবার, ঔষধ, এবং মিষ্টি—সব কিছুর দাম বাড়তে শুরু করেছে।
মোবাইল ফোনে কথা বলার খরচ বেড়ে যেতে পারে, যা মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে।
রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম ইতোমধ্যে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন অনেক ভোক্তা।
মিরপুরের বাসিন্দা আফসানা বেগম বলেন, “ঔষধের দাম এমনিতেই বেশি, এখন এই ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে খরচ আরও বেড়ে গেল।”
অন্যদিকে, আমিনুল ইসলাম নামের একজন পোশাককর্মী বলেন, “এক বাটি হালিমের দাম এক মাসের মধ্যে ৫০ টাকা বেড়ে গেছে, এরপর আরও কত বাড়বে?”
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সরকারের এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছে।
সংগঠনটি বলছে, “উৎপাদন খরচ বাড়লে পণ্যের মূল্যও বাড়বে, যা মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে তুলবে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে ছোট ব্যবসা এবং মধ্যম আয়ের পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এলপি গ্যাস এবং ফলের রসের মতো পণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়ে যেতে পারে।
বর্তমান ব্যবস্থায় ভ্যাট বৃদ্ধি সরাসরি ভোক্তার পকেটে প্রভাব ফেলবে, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ব্যয় সরবরাহকারীরা ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে রাজস্ব বাড়লেও অর্থনীতির সার্বিক গতি মন্থর হয়ে যেতে পারে।
সরকার বলছে, নতুন অধ্যাদেশের ফলে রাজস্ব আদায়ে গতি আসবে, যা বাজেট ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে।
কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে, কারণ দৈনন্দিন পণ্যের দাম ইতোমধ্যে চড়েছে।
ভ্যাট বৃদ্ধির জনজীবনে প্রভাব
সরকারের আকস্মিক ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে জনজীবনে চাপ আরও বাড়ছে।
মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির পরিবারগুলো এ সিদ্ধান্তের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়ছে, যা ভোক্তাদের জন্য বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।
মিরপুরের বাসিন্দা আফসানা বেগম বলেন, “বাজারে এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই, তার মধ্যে এই ভ্যাট বৃদ্ধি। আমাদের কী হবে?”
ঔষধ, এলপি গ্যাস, রেস্তোরাঁর খাবার এবং ইন্টারনেটের মতো সেবার খরচ বাড়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় দ্রুত বাড়ছে।
এমনকি ফলের রসের মতো সাধারণ পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে, যা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বিলাসী পণ্য হয়ে উঠছে।
আশুলিয়ার পোশাকশ্রমিক আমিনুল ইসলাম জানান, “এক বেলা রেস্তোরাঁয় খাওয়ার জন্য এখন অতিরিক্ত টাকা লাগবে, যা আমাদের পক্ষে সম্ভব না।”
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) জানিয়েছে, এই পদক্ষেপ উৎপাদন খরচ বাড়াবে এবং বাজারে মূল্যস্ফীতি ত্বরান্বিত করবে।
উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি মানে পণ্যের দাম বাড়ানো, যা সরাসরি ভোক্তার ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং যোগাযোগ খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে আর্থিক বৈষম্য আরও প্রকট হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমূল্যের চাপ সামলাতে অনেকে তাদের দৈনন্দিন ব্যয় কমিয়ে আনতে বাধ্য হবেন।
এই ব্যয় সংকোচন অর্থনীতির বিভিন্ন খাতকে সংকুচিত করতে পারে, যার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়তে পারে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানে।
কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে গেলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং পরিবারগুলোর আর্থিক দুরবস্থা আরও তীব্র হবে।
ভোক্তারা বলছেন, সরকারের এই পদক্ষেপ দেশের নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
অনেকে মনে করছেন, ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা থেকে বের হতে অনেক সময় লাগবে।
আইএমএফ-এর চাপ এবং বিকল্প পথ
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে গিয়েই সরকার এই কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
আইএমএফের শর্তানুযায়ী, সরকারকে কর-জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে, যা বাস্তবায়নে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
সরকার চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩১ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব সংগ্রহ করেছে।
এই ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার সরাসরি ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “সরকার কর ফাঁকি রোধে উদ্যোগ নিলে এবং প্রত্যক্ষ কর বাড়ালে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ কমানো যেত।”
তিনি বলেন, “টিআইএন নম্বরধারীদের কর প্রদান নিশ্চিত করা এবং নতুন করদাতা সৃষ্টি করলে ভ্যাট বৃদ্ধির প্রয়োজন হতো না।”
প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি হলে ধনী শ্রেণি থেকে কর সংগ্রহ বাড়ানো যেত, যা বৈষম্য কমাতে সাহায্য করত।
অধ্যাপক এম এম আকাশ মনে করেন, সরকার সম্পত্তি কর পুনর্বিন্যাস করতে পারত, যা জনস্বার্থে কার্যকর হতে পারত।
তিনি বলেন, “একাধিক বাড়ি বা গাড়ির ওপর কর আরোপ করলে নিম্নবিত্ত শ্রেণির ওপর চাপ না পড়ে ধনী শ্রেণি থেকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো যেত।”
বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং কর ফাঁকির জন্য বিপুল অর্থ সরকার রাজস্ব খাতে হারাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন।
এ অর্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হলে বাজেট ঘাটতি কমানো সম্ভব হতো।
তবে সরকার এই বিকল্প পথগুলো উপেক্ষা করে ভ্যাট বৃদ্ধির মাধ্যমে দ্রুত রাজস্ব আদায়ের পথ বেছে নিয়েছে।
আইএমএফের শর্ত মেনে চলার ক্ষেত্রে সরকারের নীতিনির্ধারকদের দক্ষতার অভাব রয়েছে বলেও মত দিয়েছেন অনেক অর্থনীতিবিদ।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরনের নীতিগত ব্যর্থতার ফল ভোগ করতে হবে সাধারণ মানুষকেই।
সরকারি ব্যয় সাশ্রয়ের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয় বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকার ব্যয় কমিয়ে এবং উন্নয়ন প্রকল্পে কাটছাঁট করলেও তা রাজস্ব ঘাটতি পূরণে যথেষ্ট নয়।
তাদের মতে, দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারমুখী উদ্যোগ না নেওয়া হলে ভবিষ্যতে এমন সংকট আরও ঘনীভূত হবে।