ইসরায়েল ও হেজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে, যা বুধবার সকাল থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।
যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, আগামী ৬০ দিনের মধ্যে ইসরায়েলি সেনারা লেবানন থেকে সরে যাবে।
লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে হেজবুল্লাহর পরিবর্তে লেবানিজ সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে।
চুক্তিটি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা সংঘাতের অবসানের সম্ভাবনা জাগিয়েছে।
তবে ইসরায়েল সতর্ক করেছে, যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও বেসামরিক জনগণ যেন ঘরে ফিরে না যায়।
যুদ্ধবিরতি কার্যকরের ঘোষণা এবং শর্তাবলী
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন।
নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মঙ্গলবার রাতে তিনি এ সিদ্ধান্ত জানান।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের মধ্যস্থতায় এই চুক্তি সম্ভব হয়েছে বলে জানানো হয়।
যুদ্ধবিরতির আওতায় ইসরায়েল ধাপে ধাপে তাদের সেনাদের দক্ষিণ লেবানন থেকে প্রত্যাহার করবে।
লেবাননের সামরিক বাহিনী দক্ষিণাঞ্চলে মোতায়েন হবে এবং তারা ব্লু লাইনের আশপাশে টহল দেবে।
ইসরায়েলের পাশাপাশি হেজবুল্লাহও তাদের অবস্থান থেকে সরে যাবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
চুক্তিটি কার্যকর করতে লেবাননের সামরিক বাহিনীকে আন্তর্জাতিক সাহায্যের আওতায় উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্স এই চুক্তির স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে সরাসরি নজরদারি করবে।
লেবাননে জাতিসংঘের অন্তর্বর্তীকালীন বাহিনী (ইউনিফিল)ও এই চুক্তি বাস্তবায়নে অংশ নেবে।
চুক্তি কার্যকরে সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের অভিযোগগুলো সমাধানের জন্য নির্দিষ্ট কোনও ফোরামের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
যুদ্ধবিরতির সম্ভাব্য কারণ
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতির কারণ হিসেবে বেশ কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেছেন।
প্রথমত, ইরানের হুমকির প্রতি নজর দিতে চায় ইসরায়েল।
তিনি দাবি করেছেন, ইসরায়েল ইতিমধ্যে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধ্বংস করেছে।
ইরানের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যাওয়ার আগে ইসরায়েল চায় হেজবুল্লাহর সামরিক সক্ষমতা দুর্বল করতে।
হেজবুল্লাহকে ইরানের প্রধান প্রতিরক্ষার ঢাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তবে ইসরায়েলের আক্রমণে হেজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডারের বড় অংশ ধ্বংস হয়েছে।
ফলে হেজবুল্লাহর সামরিক সক্ষমতা এখন সীমিত হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলি সেনাদের পুনরায় সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
দুইটি ভিন্ন ফ্রন্টে একযোগে যুদ্ধ চালানো ইসরায়েলের জন্য দীর্ঘমেয়াদে সম্ভব নয়।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীকে গাজার সংঘাতেও সম্পৃক্ত করতে হবে।
লেবানন থেকে সেনা প্রত্যাহারের মাধ্যমে গাজায় আরও বেশি সেনা মোতায়েন করা সম্ভব হবে।
তৃতীয়ত, হেজবুল্লাহকে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে দেওয়া মানে হামাসের ওপর চাপ বাড়ানো।
হামাস বরাবরই ইরানের সমর্থিত প্রতিরোধ আন্দোলনের অংশ হিসেবে হেজবুল্লাহর ওপর নির্ভরশীল।
হেজবুল্লাহ যুদ্ধ থেকে সরে গেলে হামাসকে একা প্রতিরোধ করতে হবে, যা তাদের দুর্বল করবে।
এই যুদ্ধবিরতি ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত বিজয়ের অংশ বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক
এই যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে অনেকেই ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী, ইসরায়েলি বাহিনী এবং হেজবুল্লাহ যোদ্ধাদের স্থানান্তরিত করার পর দক্ষিণ লেবাননে লেবানিজ সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে।
তবে লেবাননের সামরিক বাহিনী এই দায়িত্ব পালনের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত নয় বলে মনে করছেন সামরিক বিশ্লেষকরা।
লেবাননের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বারবার সরঞ্জাম, অর্থ ও মানবসম্পদ সংকটের অভিযোগ উঠেছে।
বিশেষ করে, দক্ষিণ লেবাননে হেজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটি ও দীর্ঘদিনের প্রভাবের কারণে তাদের কার্যকর উপস্থিতি নিয়ে সংশয় রয়েছে।
অনেকে আশঙ্কা করছেন, এই এলাকায় লেবানিজ সেনাদের পর্যাপ্ত ক্ষমতা এবং কৌশলগত সুবিধা না থাকলে সেখানে আবারও সংঘাত শুরু হতে পারে।
এ ছাড়া ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার প্রক্রিয়ায় দেরি হলে চুক্তি ভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
যুদ্ধবিরতির মূল লক্ষ্য ছিল দুই পক্ষকে অস্ত্র বিরতিতে আনা।
তবে এখনও হেজবুল্লাহর অস্ত্র ভাণ্ডার এবং ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নিয়ে কোনো স্পষ্টতা নেই।
চুক্তি কার্যকরের পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ
যুক্তরাষ্ট্রের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির শর্তগুলো বাস্তবায়ন করতে ৬০ দিনের মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনীকে ধাপে ধাপে দক্ষিণ লেবানন থেকে প্রত্যাহার করা হবে।
এই সময়ের মধ্যে লেবাননের সামরিক বাহিনী ব্লু লাইনের আশপাশের এলাকাগুলোতে তাদের কার্যক্রম শুরু করবে।
তবে লেবানিজ সেনাদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং তাদের টহল কার্যক্রম নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্স এই অঞ্চলে জাতিসংঘের অন্তর্বর্তীকালীন বাহিনীর (ইউনিফিল) সঙ্গে মিলে একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠন করবে।
এই কমিটি লেবাননের সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদানে ভূমিকা রাখবে।
এ ছাড়া, লেবাননের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কাজ করতে হবে।
তবে, চুক্তির অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো, দুই পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস দূর করা।
ইসরায়েল এবং হেজবুল্লাহ একে অপরের প্রতি ক্রমাগত অভিযোগ এনে চলেছে।
এই পরিস্থিতিতে, যুদ্ধবিরতির পুরো প্রক্রিয়ায় প্রতিটি পদক্ষেপ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, যদি লেবাননের সামরিক বাহিনী এই শূন্যস্থান পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে হেজবুল্লাহ সহজেই তাদের অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে পারে।
হেজবুল্লাহ: সামরিক শক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব
হেজবুল্লাহ লেবাননের সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি সংগঠন।
১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে ইরান-সমর্থিত এই সংগঠনটি গঠিত হয়েছিল মূলত ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরোধিতা করার জন্য।
গোষ্ঠীটি ইরানের অর্থায়ন ও সামরিক সহায়তায় ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে।
হেজবুল্লাহর সশস্ত্র শাখা ইসরায়েল এবং মার্কিন বাহিনীর ওপর মারাত্মক হামলা চালিয়েছে।
লেবাননের রাজনৈতিক অঙ্গনে সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রধান শক্তি হিসেবে অবস্থান করছে।
এটি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকেছে।
হেজবুল্লাহর সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তাদের বিশাল ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার এবং দক্ষ যোদ্ধাদের উপস্থিতি।
২০০৬ সালের ইসরায়েল-হেজবুল্লাহ যুদ্ধের পর গোষ্ঠীটি আরও শক্তিশালী হয়েছে এবং সীমান্ত এলাকায় তাদের দখল আরও দৃঢ় হয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্ব, ইসরায়েল এবং আরব লীগের দেশগুলো হেজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে।
এদিকে, লেবাননের জনগণের একটি অংশ মনে করে, হেজবুল্লাহ লেবাননের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তবে, সাম্প্রতিক সংঘাতে হেজবুল্লাহর সামরিক শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চুক্তি কার্যকরের ভবিষ্যৎ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
যুদ্ধবিরতির এই চুক্তি যদি কার্যকর হয়, তবে এটি ইসরায়েল এবং হেজবুল্লাহর দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতের সমাপ্তি ঘটাতে পারে।
তবে, এই শান্তি কতটা স্থায়ী হবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করবে চুক্তির শর্তগুলো বাস্তবায়নের উপর।
লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সীমান্ত এলাকায় হেজবুল্লাহর পুনর্গঠনের আশঙ্কা চুক্তি কার্যকরের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকলেও লেবাননের সামরিক শক্তির সীমাবদ্ধতা এই প্রক্রিয়াকে দুর্বল করতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসরায়েল এই চুক্তির মাধ্যমে একটি কৌশলগত অবস্থান নিশ্চিত করতে চায়।
অন্যদিকে, হেজবুল্লাহ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য চুক্তি মেনে নিয়েছে।
যদি এই চুক্তি দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি বড় সংঘাতের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।