ইসরায়েল তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি সত্ত্বেও লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে স্থল অভিযান শুরু করেছে। এই অভিযান মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান অক্ষমতা ও কূটনৈতিক ব্যর্থতাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। আঞ্চলিক সংঘাতে একসময় প্রভাবশালী ভূমিকা রাখা যুক্তরাষ্ট্র এখন কার্যত একটি পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় অবস্থান করছে, তার দীর্ঘদিনের মিত্র ইসরায়েল ও অন্যান্য শক্তিধর আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
ইসরায়েলের অভিযানের নতুন ধাপ এবং ওয়াশিংটনের দাবি উপেক্ষা
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার সোমবার হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের নতুন ধাপে প্রবেশ করেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী এই পদক্ষেপকে একটি “সীমিত স্থল অভিযান” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তবে, এই অভিযান শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক আহ্বান উপেক্ষা করে। ওয়াশিংটন ইসরায়েলকে বারবার সংযত থাকার আহ্বান জানালেও তা কোনোরকম প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়নি।
এই অভিযান শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাংবাদিকদের জানান, “আমাদের এখনই যুদ্ধবিরতি করা উচিত,” যখন তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল ইসরায়েলের বিশেষ বাহিনীর লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে আগের অভিযানের বিষয়ে। বাইডেন আরও বলেন, “আমি স্বস্তিতে আছি যদি তারা থামে।”
বাইডেনের এই মন্তব্য ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের মধ্যে সম্পর্কের ফাটলকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। নেতানিয়াহু একই দিনে ইরানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে ইসরায়েল পৌঁছাতে পারে না।” ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য তার আঞ্চলিক শক্তি প্রদর্শনের প্রতিফলন। তবে, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার কূটনৈতিক সম্পর্কের দূরত্বও তুলে ধরেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপমানজনক অসহায়ত্ব: ইসরায়েলি সংঘাতের পুনরাবৃত্তি
গত বছরের অক্টোবর ৭ তারিখ হামাসের ইসরায়েলে আক্রমণ, যেখানে প্রায় ১,২০০ জন ইসরায়েলি নিহত হয়, সেই ঘটনার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত ইসরায়েলকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু ইসরায়েল প্রতিবারই এই আহ্বানকে উপেক্ষা করেছে এবং নিজস্ব সামরিক পদক্ষেপ চালিয়ে গেছে।
ইসরায়েল প্রায়ই নিজ সিদ্ধান্তে চলেছে এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছে, এমনকি যখন তার কর্মসূচি মার্কিন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি বিমান হামলা শুক্রবার হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করে, কিন্তু এ ধরনের একটি আক্রমণের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে আগাম কিছু জানানো হয়নি। এই ধরনের সিদ্ধান্ত কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছে, এবং বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তির অবনতি ঘটাচ্ছে।
ইসরায়েলের এই একতরফা সিদ্ধান্তগুলি বাইডেন প্রশাসনকে কার্যত একটি দর্শকের ভূমিকায় পরিণত করেছে। যেটি বিশ্বমঞ্চে একটি সুপারপাওয়ারের মর্যাদার সাথে খাপ খায় না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন মাসের পর মাস মধ্যপ্রাচ্যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, কিন্তু সেগুলো ফলপ্রসূ হয়নি। বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে গাজার যুদ্ধবিরতির জন্য একাধিক আহ্বান জানানো হলেও, নেতানিয়াহু ও হামাসের কেউই এই আহ্বানে সাড়া দেয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তিগত মর্যাদার হ্রাস ও ইসরায়েলের জেদী অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি কেবল একটি কূটনৈতিক লজ্জা নয়, এটি ব্যক্তিগতভাবে বাইডেনের মর্যাদা এবং বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রতি ধারণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাইডেন, যিনি তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নিজেকে একজন বিদেশনীতি বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যের এই সংঘাতের মুখে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। এবং এমন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে যে, কয়েক মাসের মধ্যে তিনি হোয়াইট হাউস ছেড়ে যাবেন, যখন মধ্যপ্রাচ্যের এই জ্বলন্ত সংঘাত তার রাজনৈতিক জীবনের একটি কালো দাগ হিসেবে থেকে যাবে।
যদিও নেতানিয়াহু তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বন্দ্বের পরেও তার যুদ্ধে অটল রয়েছেন, তার সরকার এই বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী যে বাইডেন প্রশাসন শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে বাধ্য থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, এপ্রিল মাসে ইরানের একটি বড় মিসাইল এবং ড্রোন আক্রমণ প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইসরায়েলকে সহায়তা করেছিল। সেই আক্রমণটি আসে একটি ইসরায়েলি হামলার পরে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রকে আগাম কিছু জানানো হয়নি। এই হামলায় ইরানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ রেভল্যুশনারি গার্ড অফিসার নিহত হয়।
ইসরায়েলি রাজনৈতিক কৌশল: নেতানিয়াহুর শর্তে সংঘাত পরিচালনা
নেতানিয়াহু প্রায়ই বাইডেনের অস্বস্তির সুযোগ নেন। বাইডেন দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের একজন প্রবল সমর্থক হিসেবে পরিচিত। কিন্তু নেতানিয়াহু বুঝেছেন যে বাইডেন শেষ পর্যন্ত যেকোনো উস্কানি মেনে নেবেন এবং ইসরায়েলের পাশে দাঁড়াবেন। বাইডেন প্রশাসন এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের উপর সেই ধরনের চাপ প্রয়োগ করেনি, যেমন মার্কিন সামরিক সরঞ্জামের সরবরাহ বন্ধ করা, যা ইসরায়েলকে কৌশলগতভাবে দুর্বল করে দিতে পারত।
নেতানিয়াহুর প্রশাসন মনে করে, মধ্যপ্রাচ্যের এই যুদ্ধে তাদের স্বল্পমেয়াদী কৌশলগত সাফল্য পেয়েছে, যা তাকে যেকোনো সামরিক পদক্ষেপ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়। নেতানিয়াহু ইসরায়েলকে ৩০ বছরের সবচেয়ে বড় সাফল্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। ইসরায়েল অনেক শীর্ষ হিজবুল্লাহ এবং হামাস নেতাকে হত্যা করেছে। এর মধ্যে হিজবুল্লাহর নেতা নাসরাল্লাহও রয়েছেন, যিনি ইসরায়েলের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গভীরতর উদ্বেগ: আঞ্চলিক যুদ্ধের ঝুঁকি
ওয়াশিংটন, অন্যদিকে, অনেক বড় আকারের সমস্যার দিকে নজর দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে গাজা এবং লেবাননে সংঘাতের কারণে বিশাল মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয় হল, এই সংঘাতের দীর্ঘায়িত হলে তা একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধের রূপ নিতে পারে, যেখানে ইরানসহ অন্যান্য শক্তিগুলোও সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে। ইরান বরাবরই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহ ও হামাসকে সমর্থন দিয়েছে। এবং এই যুদ্ধের তীব্রতা বাড়লে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু ইরানের সাথে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ছে।
মার্কিন প্রশাসন চাইছে, তারা এই ধরনের সংঘাত থেকে দূরে থাকতে পারে। ইরাক ও আফগানিস্তানের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি বড় সংঘাতে জড়াতে চায় না। তবে নেতানিয়াহুর কৌশল ও ইসরায়েলের সামরিক কার্যক্রম মার্কিন স্বার্থকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
মার্কিন রাজনীতি ও ইসরায়েল সম্পর্ক: গভীর সংকটের মুখে বাইডেন প্রশাসন
মার্কিন-ইসরায়েল সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এবং মধ্যপ্রাচ্যের এই সংঘাতের প্রভাব শুধু বাইডেন প্রশাসনের কূটনৈতিক অবস্থানের জন্যই নয়, তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
আগামী মাসে মার্কিন নির্বাচনের কারণে বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের রাজনৈতিক অবস্থান অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বাইডেনের ইসরায়েলের ওপর সংযম আরোপ করতে ব্যর্থতা ডেমোক্রেটিক পার্টির অভ্যন্তরে গভীর বিভাজন তৈরি করেছে। বিশেষ করে প্রগতিশীল এবং আরব আমেরিকান ভোটারদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে, যারা এই সংঘাতের কারণে ক্ষুব্ধ। অন্যদিকে, রিপাবলিকানদের অনেকেই ইসরায়েলের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আসছে এবং তারা বাইডেনকে কূটনৈতিকভাবে ব্যর্থ বলে আখ্যা দিচ্ছে।
বাইডেনের জন্য এটি একটি জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। একদিকে তাকে তার দীর্ঘদিনের মিত্র ইসরায়েলের পাশে থাকতে হবে, অন্যদিকে তাকে আমেরিকার জনগণের বড় অংশের কাছে নিজের বৈধতা বজায় রাখতে হবে।