আন্দোলনকারী ছাত্র
,

রাষ্ট্রপতি অপসারণের দাবিতে সমন্বয়কদের আন্দোলন: সরকার কি এবার সেই পথে হাঁটবে?

ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা কেন রাষ্ট্রপতি অপসারণের দাবি তুললেন?

বাংলাদেশে ক্ষমতা পরিবর্তনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুইজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হঠাৎ করেই দাবি তুলেছেন যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে অবিলম্বে তার পদ থেকে অপসারণ করা উচিত।

এই দাবি সমাজের বিভিন্ন স্তরে তোলপাড় শুরু করেছে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং সংবাদমাধ্যমে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং সারজিস আলম তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইল থেকে একই দিনে রাষ্ট্রপতি অপসারণের দাবি জানিয়েছেন।

তাদের এই দাবির সঙ্গে আরও চারটি দাবি যুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো— আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিতকরণ, নতুন সংবিধান গঠন, আওয়ামী দুর্নীতিবাজ আমলাদের পরিবর্তন, এবং হাসিনার আমলে করা অবৈধ চুক্তি বাতিল করা।

সমন্বয়কদের দাবি অনুযায়ী, বর্তমান রাষ্ট্রপতি হাসিনার আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় তাকে পদে রাখা রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।

আন্দোলনের ইতিহাস: কেন রাষ্ট্রপতির অপসারণ দাবি?

২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কার।

তবে, ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ধীরে ধীরে যোগ হয় আরও বড় রাজনৈতিক দাবি, যার মধ্যে প্রধানত আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ছিল অন্যতম।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের গঠনের পরেও আন্দোলনের সুর থামেনি। বরং নতুনভাবে রাষ্ট্রপতির অপসারণসহ আরও কিছু দাবিতে আন্দোলনের নেতারা মাঠে নেমেছেন।

আন্দোলনের নেতাদের দাবি, হাসিনার পতনের পরও তার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে পদে রাখা ‘ফ্যাসিবাদের একটি সিম্বল’ ধরে রাখা হবে, যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে।

রাষ্ট্রপতির অপসারণের প্রক্রিয়া: সংবিধান কী বলে?

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করার একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে।

সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব আনা সম্ভব।

তবে বর্তমানে সংসদ না থাকার কারণে, এই প্রক্রিয়া যথেষ্ট জটিল।

সংবিধান অনুযায়ী, যদি রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন, তাহলে স্পিকার অস্থায়ীভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।

কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, সংসদ ভেঙে যাওয়ায় স্পিকারও নেই। তাই এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব কে নেবেন এবং কিভাবে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা হবে, তা এখনো অনিশ্চিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে একটি রেফারেন্সের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে।

যেহেতু আইনগতভাবে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা কঠিন, তাই সরকার যদি এই পথে যেতে চায়, তবে আপিল বিভাগ থেকে রেফারেন্স নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

রাষ্ট্রপতির অপসারণের সম্ভাবনা: আইনজ্ঞদের মতামত

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকায়, রাষ্ট্রপতির অপসারণের প্রশ্নটি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেছেন, “সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অপসারণের কোনও বৈধ প্রক্রিয়া নেই। তবে রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারেন।”

তিনি আরও বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি অপসারণের কোনও আইনি ভিত্তি নেই। তবে রাজনৈতিক চাপের মুখে রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলে, তখন আর সংসদ বা আইনি প্রক্রিয়ার দরকার হবে না।”

অতীতের উদাহরণ: ছাত্র আন্দোলনের দাবিতে প্রশাসনের রদবদল

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এর আগে প্রশাসনের বিভিন্ন পদে রদবদল ঘটেছে।

শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরও বিভিন্ন পদে পরিবর্তনের দাবি সমন্বয়কদের কাছ থেকে এসেছে।

সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের পদত্যাগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পদত্যাগ এবং সামরিক ও প্রশাসনিক বিভিন্ন পদে পরিবর্তন এসেছে ছাত্র আন্দোলনের চাপে।

আন্দোলনের নেতারা সরকারকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আনার জন্য চাপ দিয়ে আসছেন।

তাদের দাবি অনুযায়ী, প্রশাসনে যারা ফ্যাসিবাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের পদ থেকে অপসারণ করা উচিত।

সরকার কি এই দাবি মেনে নেবে?

সরকারের তরফ থেকে রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে এখনো কোনও সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আসেনি।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে সরকারের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য হলো দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং দ্রুত নতুন নির্বাচন আয়োজন করা।

এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির অপসারণের মতো একটি বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া সরকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার যদি রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের পথে হাঁটে, তবে তা আইনি জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে এবং দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে।

পরবর্তী পদক্ষেপ কী?

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দাবি যদি আরও জোরালো হয়, তাহলে সরকারকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সরকার যদি আপিল বিভাগ থেকে রেফারেন্স নিয়ে রাষ্ট্রপতির অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু করে, তবে সেটি একটি দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া হতে পারে।

অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন, তাহলে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া সহজ হবে।

কিন্তু এই পরিস্থিতিতে, সরকার এবং আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে একটি সংলাপ হওয়া জরুরি, যাতে দেশের স্থিতিশীলতা বজায় থাকে এবং কোনও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি না হয়।

সরকার যদি সমন্বয়কদের দাবির প্রেক্ষিতে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তা দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে।

আরও পড়তে পারেন