,

রাষ্ট্রপতির পদচ্যুতির দাবিতে উত্তাল বাংলাদেশ: রাজনৈতিক সংকট ও সাংবিধানিক জটিলতা

ছাত্র আন্দোলন থেকে রাষ্ট্রপতি অপসারণের দাবি, সরকার ও বিএনপির ভিন্নমত

বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের পদচ্যুতির দাবিতে চলমান আন্দোলন এখন গভীর রাজনৈতিক সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে শুরু হওয়া এই আন্দোলনে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবি জোরালোভাবে উঠেছে।

শিক্ষার্থীরা সরকারকে এই দাবিতে পদক্ষেপ নিতে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে।

শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে, সরকার রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়ে আলোচনার পথে হাঁটছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

সাংবিধানিক জটিলতা ও সংকটের আশঙ্কা

দেশের সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে তা স্পিকারের কাছে জমা দিতে হবে, এবং তাকে অপসারণ করার ক্ষমতা রয়েছে নির্বাচিত সংসদের।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং স্পিকারও পদত্যাগ করেছেন।

এমন অবস্থায় রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দেশে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

রাজনৈতিক সমঝোতার আহ্বান

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণ কোনো আইনি বিষয় নয় বরং এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।

সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “রাষ্ট্রপতির পদে থাকা বা না থাকা, এটি সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি না করে, বরং রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।”

প্রধান উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়, এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে এটাও বলা হচ্ছে যে, রাষ্ট্রপতির বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তারা ‘রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলা’কে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।

বিরোধী দল বিএনপির মতামত ও সতর্কতা

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত।

বিএনপি মনে করছে, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ করলে এটি সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি করবে, যা দেশে এক অস্থির পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে।

বুধবার বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, “রাষ্ট্রপতির পদ একটি সাংবিধানিক পদ এবং হঠাৎ পদত্যাগের মাধ্যমে একটি সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হলে দেশের সংকট আরো বাড়বে।”

বিএনপির মতামত অনুযায়ী, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণ দেশের সাংবিধানিক কাঠামোকে আরো জটিলতায় ফেলবে এবং এটি দেশের স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করবে।

সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞদের মতামত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করার কোনো সাংবিধানিক পথ খোলা নেই।

তিনি বলেন, “সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে, স্পিকার পদত্যাগ করেছেন, এবং সংবিধানও স্থগিত করা হয়নি। সুতরাং সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণের সুযোগ নেই।”

তাঁর মতে, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণ করতে হলে সংবিধানের বাইরে গিয়ে করতে হবে, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি খারাপ উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে হয় তবে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ নিয়ে জটিলতা

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণের পর নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগের বিষয়ে বিভিন্ন জটিলতা সামনে আসতে পারে।

অধ্যাপক হাফিজুর রহমান বলেন, “এ অবস্থায় সংবিধান অনুযায়ী নতুন কোনো রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা সম্ভব নয়, যা একটি সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি করবে।”

নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগের জন্য দেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি পেশাজীবী, সিভিল সোসাইটি, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, শিক্ষক, আইনজীবী ও ছাত্র সংগঠনগুলোর কনভেনশন ডেকে ঐক্যমতের ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করতে হবে।

তবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সহজ হবে না, এবং তা দেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক কাঠামোর উপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে।

জনগণের ইচ্ছা বনাম সংবিধান: জনআন্দোলনের প্রভাব

আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ছাত্রজনতা বলছে যে, রাষ্ট্রপতিকে সরানোর পাশাপাশি সংবিধান পরিবর্তনেরও প্রয়োজন রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন মনে করেন, গণআন্দোলনের মাধ্যমে দেশের সংবিধানকে সংশোধন করা বা পরিবর্তন আনা যেতে পারে।

তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার যদি জনগণের ইচ্ছায় আসে তবে সংবিধানের প্রথমেই লেখা আছে জনগণ ক্ষমতার মালিক।”

তিনি আরও বলেন, “যদি জনগণ চায় তবে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হতে পারে, কারণ এই আন্দোলন একটি বিশাল গণআন্দোলন ছিল, যা জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করছে।”

অধ্যাপক নাজনীন মনে করেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণের ইচ্ছাই মূল চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সংবিধানের প্রশ্ন এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, জনআন্দোলনের ইচ্ছাই বড় বিষয়।

বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি ও বর্তমান রাজনৈতিক সংকট

বিএনপি মনে করছে যে, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ করলে এক সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হতে পারে যা দেশের রাজনৈতিক কাঠামোর উপর চাপ সৃষ্টি করবে।

বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, “রাষ্ট্রপতির পদটি একটি সাংবিধানিক পদ এবং হঠাৎ পদত্যাগের মাধ্যমে এক সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হলে দেশের সংকট আরো বাড়তে পারে।”

অন্যদিকে, বিএনপির মতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর প্রভাব ফেলতে পারে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ, যা জনমনে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে।

প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা এবং ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গি

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রপতির পদচ্যুতি নিয়ে যে আলোচনা চলছে তাতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির আপত্তির কারণে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন দেরি হচ্ছে।

তবে ছাত্রজনতার দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকার একটি রাজনৈতিক সমঝোতার পথ খুঁজছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের শাসনব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়তে পারেন