ড. মুহাম্মদ ইউনূস
,

যেসব বিষয় অধ্যাপক ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে ফেলছে

সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি

বাংলাদেশে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র দুই মাস পার হলেও নানা ইস্যুতে সরকারকে চাপে পড়তে হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, গার্মেন্টস খাতের অস্থিরতা, সড়কে বিশৃঙ্খলা, প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক বিতর্কসহ একাধিক চ্যালেঞ্জ সরকারকে প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার বহু সমস্যা আগের আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। তবে কিছু চ্যালেঞ্জ নতুনভাবে দেখা দিয়েছে এবং তা সরকারের জন্য একটি বড় ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এ সময় জনমনে সরকারের দক্ষতা এবং ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, যা এই সরকারের জন্য সংকট তৈরির শঙ্কা জাগিয়েছে।

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অধ্যাপক মুশতাক খান বলেন, “মানুষ দ্রুত পরিবর্তন চায়, কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা সবসময় সহজ নয়। সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে এবং বাস্তবসম্মত সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।”

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি: ভোক্তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ

বর্তমান সরকারকে সবচেয়ে বড় চাপের মুখে ফেলার কারণ হলো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। সাম্প্রতিক সময়ে ডিমের দাম ডজনপ্রতি ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় ভোক্তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, সাম্প্রতিককালে ডিম এবং মুরগির বাচ্চার দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে ২০ দিনের মধ্যে ২৮০ কোটি টাকা অতিরিক্তভাবে ভোক্তাদের পকেট থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এটি যথেষ্ট নয়। সিন্ডিকেটের কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণে অভাব রয়েছে, যা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য মূলত দায়ী। অধ্যাপক মুশতাক খান বলেন, “এই সিন্ডিকেটগুলো ভেঙে দিতে হবে। বড় ব্যবসায়ীরা যেভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, তা প্রতিরোধ করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।”

গার্মেন্টস খাতের অস্থিরতা: শ্রমিক আন্দোলনের প্রতিধ্বনি

গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকদের আন্দোলন সাম্প্রতিক সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে চললেও এটি একটি বৃহত্তর সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আশুলিয়া, গাজীপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিক অসন্তোষ এবং কারখানায় অস্থিরতা বেড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চললেও এখনও অনেক স্থানে শ্রমিকদের বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্ততকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি রুবানা হক বলেন, “প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে অনেক ফ্যাক্টরি পুরোপুরি বন্ধ ছিল। এই পরিস্থিতিতে ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান, এমনকি মিয়ানমারের মতো দেশে চলে যাচ্ছেন।”

বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে, এই পরিস্থিতির অবনতি হলে ডিসেম্বরের মধ্যে গার্মেন্টস খাতের ২৫-৩০ শতাংশ অর্ডার অন্য দেশে স্থানান্তরিত হতে পারে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি: সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বর্তমানে সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনির ঘটনা এবং অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জে গণপিটুনিতে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনা এবং ঢাকার হাতিরঝিলে ফ্ল্যাট দখল নিয়ে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা।” বিশেষ করে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র‍্যাব) মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, “গুজবের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের সাইবার ইউনিট এটি সার্বক্ষণিকভাবে মনিটর করছে।”

সড়কে শৃঙ্খলার অভাব: নাগরিকদের তিক্ত অভিজ্ঞতা

ঢাকা শহর ও আশেপাশের এলাকার যানজট সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগছে, যা নাগরিকদের জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অনেকে সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করছেন এবং সড়কে শৃঙ্খলার অভাব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তাদের অভিযোগ, ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না এবং আইন প্রয়োগে শিথিলতা দেখা যাচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস যানজট নিরসনের জন্য বিশেষজ্ঞ এবং ট্রাফিক পুলিশের সহযোগিতায় দ্রুত এবং কার্যকর সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি বলে অনেকেই মনে করছেন।

প্রশাসনে অস্থিরতা এবং দুর্নীতি

জনপ্রশাসন ও মাঠ প্রশাসনে অস্থিরতা এবং দুর্নীতি বর্তমান সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সম্প্রতি জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় আকারে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠে আসায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে।

সরকার দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে তিন উপদেষ্টার সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গঠন করেছে। তবে এর ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রমে বিরাজমান অস্থিরতা পুরোপুরি দূর করা যায়নি।

রাজনৈতিক বিতর্ক: ‘রিসেট বাটন’ ইস্যু নিয়ে সমালোচনা

অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। নিউ ইয়র্কে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিটিয়েটিভের অনুষ্ঠানে ‘রিসেট বাটন’ সংক্রান্ত বক্তব্যের জন্য ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। ইউনূস সেখানে বলেছিলেন, “তরুণরা রিসেট বাটন চেপে পুরনো রাজনীতি বিদায় করেছে।” এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।

বিরোধী দলগুলো দাবি করেছে, এই মন্তব্য দেশের গর্বিত ইতিহাসকে অবমূল্যায়ন করে এবং জনগণের সংগ্রামের অবদানকে ছোট করে দেখায়।

ইউনূসের সমালোচকদের অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে ‘স্টেপ ডাউন ইউনূস’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে তাকে পদত্যাগের আহ্বান জানাচ্ছেন। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে ‘রিসেট বাটন’ বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, “অধ্যাপক ইউনূস মূলত দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে নতুনভাবে শুরু করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন, যা দেশের অর্থনীতি এবং প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।”

দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন

অধ্যাপক মুশতাক খান মনে করেন, গণঅভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় আসা সরকার হিসেবে মানুষের প্রত্যাশা বেশি। তিনি বলেন, “সরকারকে দ্রুত এবং কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বড় আকারের আর্থিক দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।”

গণঅভ্যুত্থানের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের শাস্তি দ্রুত নিশ্চিত করার দাবিও উঠেছে।

অর্থনৈতিক সংস্কার এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা

অন্তর্বর্তী সরকার এখনো অর্থনৈতিক সংস্কার এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে নানাবিধ সমস্যা থাকায় এই সরকারকে চাপের মুখে থাকতে হচ্ছে।

বিভিন্ন বিশ্লেষক মনে করেন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনতে না পারলে সংকট বাড়তে থাকবে। বিশেষ করে বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অর্থ পাচারের অভিযোগ, ব্যাংকিং খাতের ঋণখেলাপি সমস্যা এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকট নিয়ে কাজ করা জরুরি।

অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে একাধিক চ্যালেঞ্জ থাকায় দ্রুত এবং দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সেগুলোর সমাধান করা প্রয়োজন। জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য সরকারকে প্রমাণ করতে হবে যে, তারা সত্যিই ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।

উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সমস্যাগুলোর পাশাপাশি নতুন চ্যালেঞ্জও সরকারকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তাই দ্রুত এবং কার্যকরী পদক্ষেপই হতে পারে সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ।

আরও পড়তে পারেন