বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
,

ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতায় সেনাবাহিনী কী কী করতে পারবে

বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়ে একটি নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর এই নতুন ভূমিকা নিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। সেনাবাহিনীকে দেওয়া এই ক্ষমতা শুধুমাত্র জরুরি পরিস্থিতিতে কিংবা প্রশাসনিক ব্যর্থতার সময়ে কার্যকর হয়, কিন্তু এবারকার সিদ্ধান্ত ভিন্ন মাত্রা নিয়েছে।

সেনাবাহিনীর বিচারিক ক্ষমতা: কী এবং কেন?

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়েছে, যার ফলে তারা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করতে পারবে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা সামরিক আইনের পাশাপাশি বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬টি ধারায় ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। এসব ধারার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আটক করা এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করা।

এছাড়াও, সেনা কর্মকর্তারা স্থানীয় বিরোধ, অপরাধ বা বিশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে পারবেন এবং প্রয়োজনবোধে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করার পরিবর্তে সরাসরি নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। বিচারিক ক্ষমতা প্রাপ্তির ফলে তারা মাঠ পর্যায়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করবেন, যা সাধারণত নির্বাচনের সময়কালে সেনাবাহিনীর কাছে থাকেনা।

পরিস্থিতির পটভূমি

গত কয়েক মাস ধরে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ এবং সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষার্থী এবং আন্দোলনকারীদের সঙ্গে প্রশাসনের সংঘর্ষের ফলে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এরই প্রেক্ষিতে, শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সংকট মোকাবিলার জন্য সেনাবাহিনীকে নতুন ক্ষমতা প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা এমদাদুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “এখন কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সেনাবাহিনীকে প্রশাসনের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। বিচারিক ক্ষমতা পাওয়ার ফলে তারা মাঠে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরাসরি সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।”

সামরিক আদালত এবং বিচারিক ক্ষমতা: অতীত অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশে সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার ঘটনা নতুন নয়। সর্বশেষ ২০০২ সালে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় জরুরি ভিত্তিতে সেনা অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসময় বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন অপরাধ দমন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

২০০৭ সালে ‘ওয়ান ইলেভেন’ নামে পরিচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়েও সেনাবাহিনী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দায়িত্ব পালন করেছিল। তবে সেবার সেনাবাহিনীকে আলাদাভাবে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি, কারণ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর জরুরি অবস্থা জারি ছিল।

বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া নিয়ে বিতর্ক

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে দুইভাবে দেখা যেতে পারে। প্রথমত, দেশের অস্থিরতা এবং প্রশাসনের শৃঙ্খলাহীনতার জন্য সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দেওয়া যৌক্তিক হতে পারে। তবে দ্বিতীয়ত, এটি দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য হুমকি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. নুরুল হুদা বলেন, “কমিশন্ড সেনা কর্মকর্তারা যখন ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার ক্ষমতা পান, তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী নিজস্ব পদক্ষেপ নিতে পারে, যা অন্যান্য ক্ষেত্রের দায়িত্বশীলদের উপেক্ষা করেও কার্যকর করা যায়।”

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সেনাবাহিনীকে এই ধরনের ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছে। ক্ষমতাসীন দলের সাবেক নেতারা মনে করছেন, এটি দেশের নিরাপত্তার জন্য একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। তবে বিরোধী দলের নেতারা এটিকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি বিপজ্জনক উদাহরণ হিসেবে দেখছেন।

একটি বিরোধী দলের মুখপাত্র বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হলো এমন একটি পদক্ষেপ, যা দেশের মানুষের অধিকার খর্ব করতে পারে। সেনাবাহিনীর ভূমিকা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায়, কিন্তু এই ক্ষমতা দিয়ে তাদের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা হলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে।”

সেনাবাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গি

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য এখনো দেওয়া হয়নি। তবে সামরিক বাহিনীর অনেকে মনে করছেন, দেশের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার জন্য এটি একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। তারা বলছেন, সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলো দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলেছে, এবং প্রশাসনের একার পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

ভবিষ্যৎ পরিণতি

সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার ফলে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং প্রশাসনের মধ্যে একটি নতুন ধারা শুরু হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব দেশের গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের ওপর পড়তে পারে। এছাড়া, সেনাবাহিনীকে প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়টি আগামীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নতুন সংকট তৈরি করতে পারে বলে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কতটা কার্যকর হবে এবং কতটা ন্যায়সংগত থাকবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে দেশটির ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর এই ক্ষমতা একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হবে তা বলা যায়।

আরও পড়তে পারেন