মাহমুদুর রহমান
,

মাহমুদুর রহমানের কারাবাস: সজীব ওয়াজেদ জয় অপহরণ মামলা এবং এর পেছনের ঘটনা

রোববার, ২৯শে সেপ্টেম্বর, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন এবং জামিনের আবেদন জানান। তবে আদালত তার জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আদালত তার কারাদণ্ডের সাজা কার্যকর করার জন্য এ নির্দেশ দেন, যা তার বিরুদ্ধে সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণের পরিকল্পনায় জড়িত থাকার মামলায় দেয়া হয়েছিল।

২০২৩ সালের ১৭ই অগাস্ট ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট মাহমুদুর রহমানসহ পাঁচজনকে পৃথক ধারায় সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। মামলার অভিযোগ ছিল, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে এবং উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে আমেরিকায় অপহরণ ও হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। এই মামলার অপরাধে অভিযুক্তদের মধ্যে অন্যতম সাংবাদিক শফিক রেহমানও ছিলেন।

মামলার ইতিহাস এবং অভিযোগ

সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণের ষড়যন্ত্রের মামলাটি ২০১৫ সালে দায়ের করা হয়। মামলার অভিযোগ অনুসারে, ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিএনপি এবং তার সহযোগী দলগুলো একত্রিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে জয়কে অপহরণ ও হত্যার ষড়যন্ত্র করে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৫ সালের ৩রা অগাস্ট ঢাকার পল্টন মডেল থানায় ডিবি পুলিশের একজন পরিদর্শক বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। ২০১৮ সালে পুলিশ পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়।

মামলার বিবরণ অনুযায়ী, অভিযুক্তরা এ ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে। মামলায় সজীব ওয়াজেদ জয়সহ মোট ১২ জন সাক্ষী দেন। এর ভিত্তিতেই আদালত মাহমুদুর রহমান এবং অন্য চারজনকে সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করে।

মাহমুদুর রহমানের আইনজীবীর বক্তব্য

মাহমুদুর রহমানের আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ জানান, যেহেতু মাহমুদুর রহমান সাজাপ্রাপ্ত আসামি, তাই আদালত তাকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, “আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমরা আপিল করবো এবং আপিলের মাধ্যমে সাজার স্থগিতাদেশের জন্য আবেদন করা হবে।”

মেজবাহ আরো উল্লেখ করেন যে, মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং এটি সত্যের ভিত্তিতে নয়, বরং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আনা হয়েছিল।

মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অন্য মামলাগুলো

মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা এবং অভিযোগের সংখ্যা প্রায় ১৩০টি। এগুলোর মধ্যে মানহানির মামলা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রদ্রোহ, বিচারপতির কথোপকথন ফাঁস, আর্থিক প্রতারণা, বিস্ফোরক দ্রব্য আইন লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তার আইনজীবী দাবি করেছেন, এসব মামলার অধিকাংশই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আনা হয়েছিল।

২০১০ সালে প্রথমবারের মতো মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার হন। তখন আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশক হাসমত আলীর করা প্রতারণার মামলায় তাকে আটক করা হয়। সেই সঙ্গে আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনাও স্থগিত করা হয়। পরে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করলে তিনি ছাড়া পান, তবে দীর্ঘদিন কারওয়ান বাজারে আমার দেশ পত্রিকার কার্যালয়েই অবস্থান করেন, কারণ তাকে পুনরায় গ্রেফতারের আশঙ্কা ছিল।

২০১৩ সালে, তাকে আবার গ্রেফতার করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতির কথোপকথন ফাঁসের অভিযোগে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাও দায়ের করা হয় তার বিরুদ্ধে। এছাড়াও হরতালে গাড়ি পোড়ানোর মামলাতেও তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

তিন বছরের কারাবাস এবং জামিন

২০১৩ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর মাহমুদুর রহমান প্রায় সাড়ে তিন বছর কারাগারে বন্দী ছিলেন। তিনি ২০১৬ সালে জামিনে মুক্তি পান। কারাবাসের পর, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলায় তাকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তিনি সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দেননি।

২০১৭ সালে জামিনে মুক্ত হয়ে মাহমুদুর রহমান বিদেশে চলে যান। প্রথমে তিনি মালয়েশিয়ায় এবং পরে তুরস্কে অবস্থান করেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি তুরস্ক থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং রোববার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।

আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং আইনি বাধা

আমার দেশ পত্রিকা একটি দীর্ঘদিনের বিতর্কিত সংবাদমাধ্যম হিসেবে পরিচিত। ২০১৩ সালে আমার দেশ পত্রিকার প্রিন্ট সংস্করণ বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর, ২০১৬ সালে সরকারের পক্ষ থেকে উস্কানিমূলক তথ্য প্রচারের অভিযোগে আমার দেশ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণসহ আরো ৩৫টি ওয়েবসাইট বন্ধ করা হয়। এই ওয়েবসাইটগুলোকে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের তথ্য বিকৃত করে প্রচারের অভিযোগ আনা হয়েছিল।

এ ধরনের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিয়ে তখন বিতর্ক উঠেছিল। কিছু মহল থেকে দাবি করা হয়েছিল, আমার দেশ পত্রিকাকে টার্গেট করা হয়েছে কারণ এটি সরকারের বিরোধিতা করতো এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে।

গ্রেফতারের প্রেক্ষাপট

২০১৩ সালে, আদালত অবমাননার অভিযোগে তাকে আটক করা হয় এবং পরবর্তীতে অন্য মামলা যোগ হয়। সেই সময়, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ তার গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছিল। এরপর থেকে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় নানাবিধ মামলা দায়ের হতে থাকে, যার মধ্যে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক বিষয়ে অভিযোগ ছিল।

ভবিষ্যতের আইনি পদক্ষেপ

মাহমুদুর রহমান এবং তার আইনজীবীরা বিশ্বাস করেন যে তারা আপিলের মাধ্যমে সাজার স্থগিতাদেশ পাবেন। তার আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ বলেন, “আমরা শীঘ্রই উচ্চ আদালতে আপিল দায়ের করবো এবং আশা করি সেখানে সঠিক বিচার পাবো।”

মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে যেসব মামলা চলছে, সেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে তিনি দাবি করেন। তার আইনজীবীর মতে, রাষ্ট্র তাকে নিস্তব্ধ করার জন্য নানা রকম মামলা দিয়েছে, যা কোনো সুষ্ঠু আইনি প্রক্রিয়ার অংশ নয়।

রাজনৈতিক বিতর্ক

মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার এবং তার বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে দেশে নানা ধরনের রাজনৈতিক বিতর্ক রয়েছে। বিএনপি এবং এর সহযোগী দলগুলো মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলাগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছে। তাদের মতে, সরকার তাকে দমিয়ে রাখতে এবং তার পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশিত সমালোচনা থামানোর জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। অন্যদিকে, সরকার দাবি করে আসছে যে এসব মামলার অভিযোগগুলো আইনানুগ এবং মাহমুদুর রহমান প্রকৃতপক্ষে অপরাধে জড়িত ছিলেন।

আরও পড়তে পারেন