সরকারের নির্দেশনা এবং মানবাধিকার প্রশ্নবোধক
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ঘটনায় অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে কোনো মামলা, গ্রেফতার বা হয়রানির নির্দেশনা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই নির্দেশনায় গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখা আন্দোলনকারীদের কোনো ফৌজদারি আইনের আওতায় আনা হবে না। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, কেন এ ধরনের দায়মুক্তির প্রয়োজন, এবং কতটা আইনসম্মত এই সিদ্ধান্ত? বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে এমন দায়মুক্তির ব্যবস্থা নেয়া আইনের পরিপন্থী হতে পারে।
আন্দোলনের পটভূমি এবং পরিস্থিতি
গত জুলাই ও আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে সংগঠিত একটি বৈষম্যবিরোধী গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এ সিদ্ধান্ত আসে। সরকারের বিরুদ্ধে একটি এক দফা আন্দোলনের ডাকে দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আন্দোলনের দাবিগুলোতে প্রধানত সরকারের ফ্যাসিস্ট নীতির পতন এবং বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল। বিভিন্ন জেলায় সহিংসতা দেখা দেয় এবং আন্দোলনের সময় পুলিশ, বেসামরিক লোকজন, এবং আন্দোলনকারীরা প্রাণ হারায়।
বিশেষত, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে থানায় হামলার ঘটনায় ১৩ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা এবং নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে পুলিশের কনস্টেবলকে পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনা জনমনে গভীর প্রভাব ফেলে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, জুলাই এবং আগস্টের এই সময়ে পুলিশ সদস্যসহ অনেকেই প্রাণ হারান এবং বহু সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়, মোট ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এ সময় পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগও ওঠে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
দায়মুক্তির ঘোষণা: কী বলা হয়েছে?
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই দায়মুক্তি শুধুমাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী এবং গণঅভ্যুত্থানকে সমর্থনকারীদের জন্য প্রযোজ্য হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, “এ গণঅভ্যুত্থানকে সাফল্যমণ্ডিত করতে যেসব ছাত্র-জনতা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের মাঠে থেকে এর পক্ষে কাজ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সংগঠিত গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য কোনো মামলা, গ্রেফতার বা হয়রানি করা হবে না।”
কিন্তু ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন সংশ্লিষ্ট অন্যসব গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা বলা হয়নি। মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, এই সময়কালে পুলিশ হত্যার ঘটনা বা লুটপাটের মত গুরুতর অপরাধের তদন্তে পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবে।
কারা দায়মুক্তি পাচ্ছে?
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় থেকে অংশ নিয়ে মাঠে ছিল এবং আন্দোলনের পক্ষে কাজ করেছেন, তারাই এই দায়মুক্তি পাবেন। তার বক্তব্য অনুসারে, “যে কোনো বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পর এতে যারা অংশ নেয় তাদের হয়রানি থেকে মুক্ত রাখতে এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়।” তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, এ ধরনের দায়মুক্তি দেওয়ার ঐতিহাসিক উদাহরণ রয়েছে।
যারা আন্দোলনের সময় সাধারণ জনতা থেকে আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন কিন্তু কোন গুরুতর অপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন না, তারাও এই দায়মুক্তির আওতায় পড়বেন।
গুরুতর অপরাধে দায়মুক্তির প্রশ্ন: আইন কি বলে?
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না বলছেন, দায়মুক্তি দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত আইনসঙ্গত নয়। তার মতে, “ফৌজদারি অপরাধে কাউকেই দায়মুক্তি দেয়ার সুযোগ নেই।” আইনজীবীরা বলছেন, গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে তদন্ত ও বিচার অব্যাহত রাখতে হবে, অন্যথায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। ২০০২ সালে যৌথ বাহিনীর পরিচালিত অপারেশন ক্লিনহার্টের সময়ও এমন একটি প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল যা পরে হাইকোর্ট বাতিল করেছিল।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটনও একই কথা বলেন। তিনি বলছেন, “ফৌজদারি অপরাধ থাকলে সেটি নির্দেশনা দিয়ে আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে রাখার সুযোগ থাকে না। এখন বা ভবিষ্যতেও এসব ঘটনায় মামলা বা বিচারের সুযোগ থাকবে।”
অতীতে দায়মুক্তির উদাহরণ
বাংলাদেশের ইতিহাসে দায়মুক্তি দেয়ার উদাহরণ রয়েছে। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দায়মুক্তি দিয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। তবে, ১৯৯৬ সালে সেই অধ্যাদেশ বাতিল করা হয় এবং হত্যার সাথে জড়িত ছয়জনের বিচার ও শাস্তি কার্যকর হয়। এছাড়া ১৯৭৪ সালে রক্ষী বাহিনীর কার্যক্রম থেকে তাদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছিল।
২০০২-০৩ সালের অপারেশন ক্লিনহার্টে ৪০ জনের মৃত্যু হলেও, হাইকোর্ট তা অবৈধ ঘোষণা করে এবং পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিকার চাইবার অধিকার নিশ্চিত করে।
আন্দোলনের সময় কী ঘটেছিল?
আন্দোলনের সময় বহু স্থানে পুলিশ এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ হয়। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর আক্রমণ ও সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ১৫ জুলাই থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে পুলিশ সদর দফতর মোট ৪৪ জন পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর কথা জানায়।
বিশেষত, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে থানা আক্রমণের ঘটনায় ১৩ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন। এর পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক গ্রেপ্তার অভিযান চালায় এবং অক্টোবর মাসের তের দিনেই তিন হাজার ১৯৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, যারা প্রকৃত অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গ্রেপ্তার অভিযানের ফলাফল ও বর্তমান পরিস্থিতি
পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সহিংসতা দমনে ১৬৯৫টি মামলা হয়েছে এবং ব্যাপক গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু অনেক জায়গাতেই হত্যাকাণ্ড বা গুরুতর অপরাধের দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি। আন্দোলনকারীদের মধ্যে সাধারণ ছাত্র-জনতাকে হয়রানি থেকে মুক্ত রাখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা দেয়া হলেও, গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
এ সময় বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের ওপর হামলা এবং হত্যার ঘটনা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়। জেড আই খান পান্না এবং অন্যান্য মানবাধিকার কর্মীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবহারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা মনে করেন, ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশি গুলির ঘটনা, হত্যাকাণ্ড এবং থানা লুটপাটের ঘটনাগুলোর ন্যায়বিচার হওয়া উচিত।
কিন্তু আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে হওয়া সহিংসতাও ছিল চ্যালেঞ্জিং। বেশ কয়েকটি থানায় আক্রমণ এবং অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটে, যা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে।
দায়মুক্তির নৈতিক এবং আইনগত প্রভাব
মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবীরা বলছেন, দায়মুক্তি দেয়ার এমন প্রচেষ্টা আইনের শাসনের প্রতি প্রভাব ফেলতে পারে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে আন্দোলনকারীদের যেমন অধিকার রয়েছে, তেমনি আইন ও মানবাধিকারের রক্ষাও জরুরি। একইসাথে গুরুতর অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা আইনানুগতার প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়।
ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেওয়া হলে বিচার পাওয়ার অধিকার ক্ষুণ্ন হতে পারে এবং ভবিষ্যতে এমন অপরাধের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা বাড়তে পারে। এজন্য অনেক আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা দাবি করছেন যে, সকল অপরাধের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
ভবিষ্যতের পথে
সরকারের এই সিদ্ধান্ত বিভিন্ন মহলে ভিন্নমত এবং বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক সংকট, আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রেক্ষাপটে দায়মুক্তির এই ঘোষণা আন্দোলনকারীদের সুরক্ষা দেয়ার একটি প্রচেষ্টা হতে পারে। তবে, গুরুতর অপরাধের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে যে শর্ত দেয়া হয়েছে, তা কতটা কার্যকর হবে, সেটি এখন দেখার বিষয়।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবী যে, জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার ক্ষুণ্ন না করে আন্দোলনকারী এবং সাধারণ জনগণকে হয়রানি থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এদিকে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা অপরিহার্য।