ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, মাংস কেনায় হিসাবি পদক্ষেপ
সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা আবুল কালাম আগে প্রতি সপ্তাহে মাংস কিনলেও এখন মাসে মাত্র দুবার কেনেন।
মুদ্রাস্ফীতি ও বাজারমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তার ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।
প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনায় অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে মাংস খাওয়া প্রায় অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছেন।
অনেক ক্রেতার মতোই তার ভোগপ্রবণতায় এসেছে সতর্কতা।
এমন ক্রেতা সংকোচনের কারণে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মাংস বিক্রেতাদের বিক্রিও কমেছে।
এক সময় যেখানে দৈনিক ১৫-২০টি খাসি বিক্রি হতো, এখন তা নেমে এসেছে ৮-১০টিতে।
বিক্রেতা সুমন মিয়া বলছেন, কাস্টমারের সংখ্যা কমে যাওয়ায় তাদের বিক্রিও হ্রাস পেয়েছে।
পাশের আরেক দোকান ‘মা-বাবার দোয়া মাংস বিতান’-এও বিক্রি নেমে এসেছে আড়াই থেকে তিন মণ মাংসে।
বিক্রেতারা বলছেন, মানুষের কাজকর্ম কমে যাওয়ায় মাংস কেনার সামর্থ্যও হ্রাস পেয়েছে।
সরকারি পরিসংখ্যান: মাংস উৎপাদন ৫০ শতাংশ হ্রাস
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন মাসে দেশে মাংস উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
জুলাই মাসে মাংস উৎপাদন ছিল ১২ লাখ ২৫ হাজার টন, যা আগস্টে নেমে আসে ৬ লাখ ৪১ হাজার টনে।
সেপ্টেম্বর মাসেও একই নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত থেকে উৎপাদন হয় ৬ লাখ ৩৯ হাজার টন।
অক্টোবর মাসে মাংস উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ লাখ টনে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, সাম্প্রতিক বন্যা এবং অতিবৃষ্টির কারণে এই পতন ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যার ফলে কিছু পশুক্ষতি হলেও উৎপাদনে এত বড় প্রভাব এখনই পড়ার কথা নয়।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি শাহ ইমরান বলেন, উৎপাদন কমার এমন তথ্যের ভিত্তি স্পষ্ট নয়।
তবে অধিদপ্তরের মতে, মাঠ পর্যায় থেকে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে অতিরঞ্জিত পূর্বতথ্যের সংশোধন হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ দামে বিপাকে ভোক্তা-বিক্রেতা
রাজধানীতে গরুর মাংস বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা কেজি দরে।
খাসির মাংসের দাম ১ হাজার ১০০ টাকা, আর মহিষের মাংস বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়।
মহিষের মাংসের সরবরাহ কমেছে ভারত থেকে চালান হ্রাস পাওয়ার কারণে।
টানা ছয় মাস ধরে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের ওপরে রয়েছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) বলছে, জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্য গ্রহণে মাসে মাথাপিছু ৩ হাজার ৫১ টাকা খরচ হচ্ছে।
২০ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, আর ৩০ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্যসংস্থান করতে পারছে না।
নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এই হার প্রায় ৩৬ শতাংশ বলে জানানো হয়েছে।
খাদ্যের দাম বৃদ্ধি ও সংকোচনমূলক ক্রয়ে জীবনযাত্রার মানে প্রভাব পড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
প্রক্রিয়াজাত মাংস বিক্রেতাদের অবস্থাও সংকটে
খোলাবাজারের মতো মাংস প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রিও হ্রাস পেয়েছে।
বেঙ্গল মিট জানাচ্ছে, তাদের সরবরাহ ফাইভ স্টার হোটেল ও আন্তর্জাতিক বাজারে হলেও বিক্রি প্রত্যাশিত মাত্রায় নেই।
বিদেশি অতিথিদের সংখ্যা কম এবং বড় পার্টি আয়োজনের অভাবে হোটেলে মাংসের চাহিদা কমেছে।
মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব রিটেইল শপের বিক্রিতেও পড়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে।
পশু খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক বন্যার প্রভাব পুরোপুরি বাজারে আসার আগে মাংস উৎপাদনে এত বড় পতন অস্বাভাবিক।
সরকারি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, অতিবৃষ্টি ও পশুক্ষতি ছাড়া অতিরঞ্জিত পুরাতন তথ্য সংশোধনের কারণেও উৎপাদনের এই পার্থক্য দেখা দিয়েছে।
মাংস উৎপাদন ও ভোগের এই চিত্র অর্থনৈতিক চাপ এবং ক্রয়ক্ষমতার সংকটকে আরও গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলছে।