অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার টেকসই হওয়ার আহ্বান
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বলেছেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তার মতে, “মব জাস্টিস” বা দলবদ্ধ সহিংসতার কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই। এজন্য শুধু নিরপেক্ষ বিচারই নয়, যথাযথ আইন প্রয়োগ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করাও জরুরি।
ফলকার টুর্ক বুধবার ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন।
এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং আইনপ্রয়োগের স্বচ্ছতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
“মব জাস্টিস” গ্রহণযোগ্য নয়
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় দলবদ্ধ সহিংসতা বা “মব জাস্টিস” বেড়েছে।
এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জাতিসংঘের হাইকমিশনার বলেন, “মব জাস্টিস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রতিটি অপরাধের তদন্ত করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার প্রতিটি মামলার সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে। না হলে এটি মানবাধিকার প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।”
তরুণদের দাবি এবং সরকারের দমনপীড়ন
ফলকার টুর্ক বলেন, “বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা বঞ্চনার শিকার হয়ে তাদের বক্তব্য প্রকাশের জন্য রাস্তায় নেমে অনন্য এক ইতিহাস তৈরি করেছে। এ সময়ে অনেক ক্ষেত্রে ভিন্নমতের উপর দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে।”
তার মতে, বাংলাদেশের তরুণদের আন্দোলনে মূলত মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ছিল প্রধান দাবি।
এ আন্দোলনের সময় বিভিন্ন অন্যায়-অবিচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে তারা মুখ খুলেছে।
বিচার প্রক্রিয়ায় যথাযথতা এবং আন্তর্জাতিক মান
একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ফলকার টুর্ক বলেন, “নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে মামলা দায়ের করা যাবে না। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”
তার মতে, যথাযথ বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা না হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনকে প্রতিহত করা সম্ভব হবে না।
এছাড়া তিনি আরও উল্লেখ করেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং অন্যান্য আইন-আদালতগুলোতে বিচার নিশ্চিত করতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা প্রয়োজন।
সাংবাদিকদের হত্যা ও অপরাধমুক্তি
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ফলকার টুর্ক।
তিনি বলেন, “সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা ও নানা অপরাধমূলক অভিযোগের বিষয়ে সঠিক তদন্ত হওয়া জরুরি। পূর্বের ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সেটি নিশ্চিত করা দরকার।”
তার মতে, সাংবাদিকরা বিভিন্ন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে এবং জনগণের পক্ষে সত্য উন্মোচনে বড় ভূমিকা পালন করে।
ছাত্রদের অভিযোগ এবং ন্যায়বিচারের দাবি
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে ফলকার টুর্ক বলেন, “শিক্ষার্থীরা আমাকে জানিয়েছে যে তাদের বক্তব্য প্রকাশের জন্য রাস্তায় নামা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এবার ন্যায়বিচার হতে হবে।”
তার মতে, সরকারের উচিত এই আন্দোলনের পেছনের বাস্তব কারণগুলো নির্ধারণ করে তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া।
ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে সংস্কারের টেকসই ব্যবস্থা
ফলকার টুর্ক মনে করেন, বাংলাদেশে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে টেকসই সংস্কার প্রয়োজন।
তার মতে, “প্রতিবার ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করতে না পারলে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নতি করতে কষ্টসাধ্য হবে।”
এবং এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হলো টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে এই প্রক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হয়।
রাজনৈতিক নির্যাতন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের প্রয়োজন
আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য রাজনৈতিক সহাবস্থান এবং মানবাধিকার চর্চার প্রয়োজন।
“প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মানবাধিকার সংক্রান্ত দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা উচিত,” তিনি যোগ করেন।
এছাড়া, তিনি উল্লেখ করেন, যেকোনও দলের সদস্যদের রাজনৈতিক মতের জন্য সন্ত্রাস দমন আইনের আওতায় অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা সঠিক নয়।
জাতিসংঘের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় খোলার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “মানবাধিকার সবার জন্য। এটি কোনো নির্দিষ্ট দেশের জন্য নয় বরং বৈশ্বিক একটি দায়িত্ব।”
ফলকার টুর্ক আশা প্রকাশ করেন যে, ভবিষ্যতে জাতিসংঘ বাংলাদেশে মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য আরও সহযোগিতা করতে পারবে।
তার মতে, “আমরা একটি মানবিক ও ন্যায়বিচারভিত্তিক বিশ্ব দেখতে চাই।”
সংস্কারের প্রয়োজন এবং ন্যায়বিচারের অনুশীলন
সংবাদ সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, “অতীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যধারার বিষয়ে নানা সমস্যার কথা সরকার জানতো। এটি আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্যও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। আমরা আশা করছি ভবিষ্যতে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার নিয়েও জনসমক্ষে আলোচনা হবে।”
তার মতে, “একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবিক এবং ন্যায়বিচারের সমাজ গঠন করতে হলে সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং সুষ্ঠু বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা প্রয়োজন।”
ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি এবং আশা
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার টুর্কের মতে, বাংলাদেশ এখন এক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এবং এই পরিবর্তন সহজ নয়।
এবং এই পরিবর্তন যদি টেকসই হয় তবে দেশের জনগণের মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, “আমি আশা করছি যে আমরা একসাথে কাজ করে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কাজ করতে পারবো।”