ড. মুহাম্মদ ইউনূস
, ,

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক: শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও ড. ইউনূসের মন্তব্য নিয়ে উত্তেজনা

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে গভীর এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে তা অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি এবং তার ভারতে অবস্থান নেয়া এই সম্পর্কের উপর বেশ প্রভাব ফেলেছে। শেখ হাসিনাকে ভারতপন্থী হিসেবে দেখা হয়, আর তার ১৫ বছরের শাসনামলে দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্কের অনেক উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটা ভিন্ন।

ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান বাংলাদেশের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকার ভারতীয় পক্ষকে অবাক করেছে। এতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও তিক্ত অবস্থার দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান

শেখ হাসিনা বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ভারতে অবস্থান করছেন, এবং তার সেখানে কতদিন থাকবেন তা এখনো পরিষ্কার নয়। এই বিষয়টি বাংলাদেশে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে তার উপস্থিতি এবং রাজনৈতিক বিবৃতির কারণে সম্পর্ক জটিল হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনা যদি ভারতে থাকেন, তবে তাকে রাজনৈতিক বিবৃতি দেওয়া থেকে বিরত রাখা উচিত। এই মন্তব্য বাংলাদেশের ভেতরে আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে, বিশেষ করে যারা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকার এবং ভারতীয় প্রতিক্রিয়া

ড. ইউনূস তার সাক্ষাৎকারে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘নিম্ন পর্যায়ে’ বর্ণনা করেছেন এবং দুই দেশের সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়ার জন্য যৌথভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে তার এই বক্তব্য ভারতের সাবেক কূটনীতিক এবং বিশ্লেষকদের মধ্যে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। তাদের মতে, ড. ইউনূস ‘মেগাফোন কূটনীতি’ ব্যবহার করছেন, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

ভারতীয় বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ড. ইউনূস এই ধরনের বিবৃতি গণমাধ্যমের মাধ্যমে না দিয়ে কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করতে পারতেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে ভারতীয় কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে ‘হতাশ’ হয়েছেন বলে জানা গেছে।

দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি এবং ভারতে অবস্থান নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় শেখ হাসিনাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি উঠেছে। বিশেষ করে বিক্ষোভের সময়ে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য একটি বড় দাবিতে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নবনিযুক্ত প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করার প্রচেষ্টা চলছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করতে পারে এমন সম্ভাবনা খুব কম।

ভারতের একজন সাবেক কূটনীতিক রিভা গাঙ্গুলি দাস এই বিষয়ে বলেছেন, শেখ হাসিনা ভারতের অতিথি হিসেবে অবস্থান করছেন, এবং ভারত তার দীর্ঘদিনের মিত্রকে সম্মান দেখাবে।

বিএনপির প্রতি ভারতের উদাসীনতা?

বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি পরবর্তী সময়ে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগে না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে কোনো ভারতীয় কর্মকর্তা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তবে চীন এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা বিএনপির সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন।

বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ইসলামপন্থীদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশঙ্কাও বাড়ছে। শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে এই গোষ্ঠীগুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং কঠোরভাবে দমন করা হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামপন্থীদের উত্থান ভারতীয় বিশ্লেষকদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা এবং ভারতের উদ্বেগ

শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত ইতোমধ্যেই এসব হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে হিন্দুদের উপর হামলার খবরে ভারত উদ্বিগ্ন।

বাংলাদেশের সুন্নি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে কিছু কট্টরপন্থী গোষ্ঠী রয়েছে, যারা মাজার এবং সমাধিকে ইসলামবিরোধী বলে মনে করে। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাজার ও সমাধিতে হামলার ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, যারা ধর্মীয় স্থানকে টার্গেট করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর উত্থান ও ভারতের বিপদ

বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিম উদ্দিন রাহমানি সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তার মুক্তির পর বাংলাদেশের ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর শক্তিশালী হয়ে ওঠার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ভারতীয় বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসলামপন্থীরা যদি বাংলাদেশে শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তাহলে তা ভারতের জন্য বিপদের ঘণ্টা বাজাবে।

শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে এই ধরনের গোষ্ঠীগুলো কঠোরভাবে দমন করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে, এবং এ বিষয়ে ভারত উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য এই ধরনের গোষ্ঠীগুলোর উত্থান একটি নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ভবিষ্যতের সম্পর্কের দিকনির্দেশনা

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এই জটিল পরিস্থিতিতে, দুই দেশের সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের জন্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার গুরুত্ব বেড়েছে। ভারতের সাবেক কূটনীতিকরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা প্রয়োজন, এবং দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ভিত্তিতে তা করা সম্ভব।

শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান এবং ড. ইউনূসের মন্তব্যের কারণে দুই দেশের মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তা কূটনৈতিক আলোচনা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে নিরসন করা না হলে ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক আরও জটিল হতে পারে।

আরও পড়তে পারেন