ভারত থেকে বাংলাদেশে নিত্যপণ্য আমদানির বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
সম্প্রতি ভারতের একজন রাজনৈতিক নেতা আলু, পেঁয়াজ ও চাল রপ্তানি বন্ধ করার হুমকি দিয়েছেন।
তার এই বক্তব্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে।
বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা দীর্ঘদিনের।
তবে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক কখনোই একপথে এগোয়নি।
ভারতের হুমকির প্রেক্ষাপটে আমদানি নির্ভরতার বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বিশেষ করে আলু, পেঁয়াজ ও চালের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতটা ভারত-নির্ভর, তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানির সার্বিক চিত্র
ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশ প্রায় সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে।
এই তালিকায় চীন শীর্ষস্থানে থাকলেও ভারতের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের মধ্যে আলু, পেঁয়াজ ও চাল অন্যতম।
যদিও বাংলাদেশ নিজস্ব উৎপাদন দিয়ে বেশ কিছু চাহিদা পূরণ করে, তবুও সরবরাহ ঘাটতি পূরণে ভারতের আমদানির ওপর নির্ভরশীল।
অন্যদিকে, রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশ ভারতের জন্য তেমন বড় বাজার নয়।
বাণিজ্য ভারসাম্যে ভারতের অবস্থান বরাবরই সুবিধাজনক।
তবে রাজনৈতিক উত্তেজনা বা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়।
ভারতীয় পণ্য আমদানিতে বারবার বাধা আসায় বাংলাদেশের নিজস্ব উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা প্রকাশ পায়।
আলুর ক্ষেত্রে নির্ভরশীলতা
বাংলাদেশে আলু একটি মৌলিক খাদ্যপণ্য।
দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৮০ লাখ মেট্রিক টন।
২০২৩ সালে আলুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক কোটি ১৬ লাখ মেট্রিক টন।
তবে প্রকৃত উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ৬ লাখ মেট্রিক টন।
উৎপাদন চাহিদার তুলনায় কম নয়, বরং বেশি।
তারপরও ২০২৩ সালে বাংলাদেশ প্রথমবার আলু আমদানি করে।
সরকার আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় মূলত বাজারে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য।
ভারত থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১৭ লাখ মার্কিন ডলারের আলু আমদানি করে।
বাংলাদেশ আলু উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও আমদানির ঘটনা বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির ইঙ্গিত দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মজুদদারি ও বাজারে সরবরাহ ঘাটতি মূল সমস্যা।
কৃষকরা উৎপাদনের পর সরাসরি বাজারে আলু বিক্রি করতে পারে না।
এ সুযোগ নেয় মধ্যস্বত্বভোগীরা, যারা আলু মজুদ করে দাম বাড়িয়ে দেয়।
কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সরবরাহ শৃঙ্খলা বজায় রাখা যাচ্ছে না।
এ অবস্থায় আমদানি নির্ভরতা কমাতে সরবরাহ ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন।
সরকারি পর্যায়ে বাজার ব্যবস্থাপনায় নজরদারি বাড়ানো জরুরি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
পেঁয়াজ: আংশিক স্বয়ংসম্পূর্ণতার পরও আমদানির ওপর নির্ভরতা
বাংলাদেশে পেঁয়াজ একটি অপরিহার্য নিত্যপণ্য।
দেশের বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৭ থেকে ২৮ লাখ মেট্রিক টন।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ৩৮ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়, যা চাহিদার তুলনায় বেশি।
তবে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, এই পর্যাপ্ত উৎপাদন সত্ত্বেও ভারত
থেকে প্রায় ২০ কোটি ডলারের পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে।
অন্যদিকে, দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বরাবরই অস্থিতিশীল।
বাংলাদেশ মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশীয় উৎপাদনে চাহিদা পূরণ সম্ভব হলেও বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে আমদানির প্রয়োজন হয়।
পেঁয়াজের চাষে কৃষকদের অনিশ্চয়তা বড় একটি সমস্যা।
এক বছরে পেঁয়াজের দাম কমে গেলে কৃষক পরের বছর চাষ করতে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে।
ফলে উৎপাদন কমে যায় এবং আমদানি নির্ভরতা বাড়ে।
মজুদদারি ও সঠিক পূর্বাভাসের অভাবও বাজারে সংকট তৈরি করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষকদের জন্য টেকসই বাজারব্যবস্থা এবং সংরক্ষণের সুযোগ তৈরি করা গেলে আমদানির প্রয়োজন কমবে।
পাশাপাশি, পেঁয়াজের চাষে দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রণয়ন এবং সরকারি হস্তক্ষেপ বাজার স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক হতে পারে।
চাল: স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রচেষ্টায় চাল আমদানির বাস্তবতা
চাল বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য।
দেশটি দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব উৎপাদনে খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার দাবি করে আসছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের চাল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ কোটি ৩৪ লাখ মেট্রিক টন।
কিন্তু বাস্তবে উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ২০ লাখ মেট্রিক টন।
উৎপাদন কম হলেও তা বার্ষিক চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট।
তবুও, ভারত থেকে চাল আমদানির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে দেড় কোটি ডলারের চাল আমদানি করে।
এর আগের অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল প্রায় ৩১ কোটি ডলার।
চাল আমদানির প্রয়োজনীয়তা বাজারে দাম ও সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে।
বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চাল আমদানি প্রায় শূন্যের কোঠায় নামতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বোরো ধানের ভালো ফলন এবং সরকারি মজুদ পরিকল্পনা এই সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
তবে, চালের বাজার ব্যবস্থাপনায় এখনও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
মজুদদারি ও সরবরাহ ঘাটতি বাজারে চালের দাম বাড়িয়ে তোলে।
সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও মজুদদারি রোধে কার্যকর নীতি গ্রহণ করলে আমদানি নির্ভরতা কমবে।
আমদানি নির্ভরতার ভবিষ্যৎ: সংকট ও সমাধান
ভারত থেকে বাংলাদেশে আলু, পেঁয়াজ ও চালের আমদানি পুরোপুরি নির্ভরতা নয় বরং সংকট সমাধানের একটি উপায়।
তবে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এই বাণিজ্যকে প্রভাবিত করতে পারে।
ভারতের রাজনীতিকরা বিভিন্ন সময় রপ্তানি বন্ধের হুমকি দিয়ে থাকেন।
এ ধরনের হুমকি বাংলাদেশের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি নির্ভরতা কমাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনায় সংস্কার প্রয়োজন।
কৃষকদের সঠিক দামে ফসল বিক্রির সুযোগ তৈরি করতে হবে।
সরবরাহ শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সরকারি তদারকি বাড়ানো দরকার।
দেশের কৃষি খাত শক্তিশালী হলে আমদানির ওপর নির্ভরতা কমবে এবং রাজনৈতিক চাপও মোকাবিলা করা সহজ হবে।
বিশেষত, নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে স্বনির্ভর হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।