৯০ বছরের দীর্ঘ পথচলায় টেস্ট জয়ে হারকে ছাড়িয়ে যাওয়ার রেকর্ড গড়ল ভারত
ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে টেস্ট ক্রিকেটে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। চেন্নাইয়ে গত মাসে বাংলাদেশকে পরাজিত করার পর, ভারত এখন টেস্ট জয়ের সংখ্যায় হারের তুলনায় এগিয়ে গেছে। ১৯৩২ সালে লর্ডসে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলার পর থেকে ৯০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, আর আজ ভারতীয় দল টেস্টে ১৭৯টি জয় এবং ১৭৮টি হার নিয়ে এক নতুন ইতিহাস গড়েছে। সুরেশ মেননের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে কিভাবে ভারত টেস্ট ক্রিকেটের শীর্ষ পর্যায়ে উঠেছে, কীভাবে দেশের ক্রিকেট ধারাবাহিক সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বমঞ্চে নিজের জায়গা করে নিয়েছে।
ভারতের টেস্ট ক্রিকেটের এই অসাধারণ যাত্রাপথ কোনো একটি সময়ের সাফল্য নয়, বরং এটি নানা যুগের সংগ্রাম, পরিবর্তন এবং দৃঢ় মানসিকতার প্রতিফলন। ভারতীয় ক্রিকেট দল ধীরে ধীরে নিজেদের শক্তিশালী করে তুলেছে এবং এখন তারা বিশ্বের শীর্ষ দলগুলোর মধ্যে একটি। তবে এই সাফল্যের পথে যে প্রতিবন্ধকতা ছিল না, তা নয়।
ভারতের শুরুর দিনগুলো: প্রত্যাশা ও সম্ভাবনার যুগ
ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের সূচনা হয় ১৯৩২ সালে লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। যদিও এই সময়ের ভারতীয় দল বড় পরিসরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য তৈরি ছিল না, তবু এটি দেশের ক্রিকেটের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য সূচনা ছিল।
১৯৮৯ সালে শচীন টেন্ডুলকারের অভিষেকের আগে পর্যন্ত ভারতের টেস্ট রেকর্ড তেমন উজ্জ্বল ছিল না। ভারত টেস্ট ক্রিকেটে ২৫৭ ম্যাচ খেলেছিল, যার মধ্যে তারা মাত্র ৪৩টি ম্যাচ জিতেছিল এবং হেরেছিল প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক ম্যাচ। ড্র হওয়া ম্যাচের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য ছিল, যা বোঝায় যে ভারতীয় দল তখনও প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতার পরিবর্তে রক্ষণাত্মক কৌশলকেই প্রাধান্য দিত।
টেন্ডুলকারের অভিষেকের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেটে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। এই ‘মাস্টার ব্লাস্টার’ কেবল একজন অসাধারণ ব্যাটসম্যান ছিলেন না, তিনি ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটে আত্মবিশ্বাস এবং জয়ের ক্ষুধা নিয়ে আসেন। তার নেতৃত্বে ভারতীয় দল ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে এবং তার সঙ্গে সমসাময়িক অন্যান্য ক্রিকেটারদের (যেমন অনিল কুম্বলে, জহির খান, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলি, এমএস ধোনি) অবদানে ভারতীয় টেস্ট দল বিশ্ব ক্রিকেটের মঞ্চে নিজেদের প্রমাণ করতে শুরু করে।
গাঙ্গুলির নেতৃত্বে টেস্ট ক্রিকেটে ভারতীয় দল
সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে ভারতীয় ক্রিকেট আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়। গাঙ্গুলি ছিলেন এমন একজন নেতা যিনি দলকে শুধু মাঠে নয়, মানসিকভাবেও দৃঢ় হতে শিখিয়েছিলেন। তার সময়কালে ভারতীয় দল বিদেশের মাটিতে ভালো পারফর্ম করতে শুরু করে। টেস্ট ম্যাচে আগ্রাসী কৌশল প্রয়োগ করা এবং প্রতিপক্ষকে চাপের মধ্যে রাখা ছিল তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। গাঙ্গুলির অধীনে ভারতীয় দল প্রথাগত ক্রিকেট কেন্দ্রগুলোর বাইরেও প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের খুঁজে বের করতে থাকে। এমএস ধোনি, যুবরাজ সিং, জহির খান, এবং আরও অনেকে ছোট শহর থেকে উঠে এসে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের প্রতিভা দেখিয়েছিলেন।
তবে শুধু প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের আবিষ্কারই নয়, গাঙ্গুলির সময়কালে ভারতীয় ক্রিকেটে পরিবর্তনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ঘরোয়া ক্রিকেটে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া। বিসিসিআইয়ের নির্দেশে দেশের পিচ কিউরেটরদের পিচে ৩ মিমি থেকে ৮ মিমি পর্যন্ত ঘাস রেখে বলার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে বলা হয়েছিল। এর ফলে ভারতীয় ফাস্ট বোলারদের উন্নতি ঘটতে থাকে এবং ব্যাটসম্যানরাও দ্রুত গতির বল মোকাবেলায় আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।
ধোনি ও টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের মনোভাবের রূপান্তর
গাঙ্গুলির নেতৃত্বের পর ভারতের ক্রিকেটকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে যান মহেন্দ্র সিং ধোনি। ধোনির নেতৃত্বে ভারতীয় দল টেস্ট ক্রিকেটে আরও বেশি নির্ভরযোগ্য এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। তার শান্ত, সংযত নেতৃত্বের ধরন এবং ম্যাচের চাপের মুহূর্তে নির্ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ভারতীয় দলকে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় রাখতে সহায়ক হয়েছিল।
ধোনির নেতৃত্বে ভারতীয় দল ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো আইসিসি টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে উঠে আসে। ধোনির অধিনায়কত্বের সময়কালে ভারতীয় দল শুধু ঘরোয়া মাটিতে নয়, বিদেশের মাটিতেও গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ জিততে সক্ষম হয়। ধোনি ছিলেন এমন একজন অধিনায়ক যিনি দলকে সংযুক্ত রাখতে জানতেন, এবং তার নেতৃত্বে ভারতীয় দল টেস্টে শক্তিশালী বোলিং ইউনিটের ওপর নির্ভর করে বিশ্ব মঞ্চে নিজেদের স্থান ধরে রাখে।
কোহলির নেতৃত্বে আক্রমণাত্মক মানসিকতার সূচনা
ধোনির অবসরের পর বিরাট কোহলির অধিনায়কত্বে ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটে নতুন যুগের সূচনা হয়। কোহলি ছিলেন এমন একজন অধিনায়ক যিনি আক্রমণাত্মক কৌশলের ওপর জোর দিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে ভারতীয় দল সবসময়ই জয়ের জন্য খেলেছে, ড্রয়ের চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে। কোহলির অধীনে ভারত টেস্ট ক্রিকেটে এক নতুন মানসিকতা নিয়ে এসেছে। তার নেতৃত্বে ভারত ৬৮টি টেস্ট খেলেছে, যার মধ্যে মাত্র ১৬ শতাংশ ম্যাচ ড্র হয়েছে, যা তাকে ইতিহাসের অন্যতম সফল টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে স্থান দিয়েছে।
২০১৪ সালে অ্যাডিলেডে তার প্রথম টেস্ট ম্যাচেই ৩৬৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে গিয়ে ভারতীয় দল প্রায় জয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি ৪৮ রানে হেরে যায়, তবে এই ম্যাচটি ভারতীয় দলের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট ছিল। কোহলি ও তার দল বুঝিয়ে দিয়েছিল যে তারা আর রক্ষণাত্মক ক্রিকেট খেলে সন্তুষ্ট নয়। তারা সবসময় জয়ের জন্য লড়বে।
দ্রুতগতির বোলিংয়ে ভারতের উত্থান
ভারতীয় ক্রিকেটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে যখন তারা দ্রুতগতির বোলিংয়ে মনোযোগ দিতে শুরু করে। অতীতে, ভারতীয় দল প্রায়শই বিদেশের মাটিতে দ্রুত গতির বোলিংয়ের সামনে অসহায় হয়ে পড়ত। বিশেষ করে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশের পেস বোলাররা ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতেন। তবে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কৌশলগত পরিবর্তনের ফলে, ভারত এখন শুধু নিজেদের মাটিতেই নয়, বিদেশের মাটিতেও ফাস্ট বোলারদের সাহায্যে ম্যাচ জিততে সক্ষম হয়েছে।
জসপ্রিত বুমরাহর মতো বোলারদের আবিষ্কার ভারতীয় দলের বোলিং শক্তিকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বুমরাহর অনন্য বোলিং অ্যাকশন এবং অসাধারণ গতি তাকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলারদের তালিকায় নিয়ে এসেছে। তার নেতৃত্বে ভারতীয় বোলিং আক্রমণ বিদেশের মাটিতেও প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইনআপকে ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।