ব্যাংক
, ,

ব্যাংক লুট বন্ধে ভিয়েতনামের কঠোর মডেল কি বাংলাদেশে কার্যকর হতে পারে?

ভিয়েতনামের শীর্ষ ধনী ট্রুং মাই লানের উত্থান ও পতনের কাহিনি যেন এক রূপকথার গল্প।

একসময় ছোটখাটো ব্যবসা করা লান পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন দেশের অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যবসায়ী।

তবে তার উত্থান এবং ধন-সম্পত্তি অর্জনের পেছনে ছিল সুপরিকল্পিত আর্থিক দুর্নীতি।

২০২২ সালে ৪৪ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

কিভাবে দুর্নীতি সংঘটিত হয়

ভিয়েতনামের আইন অনুযায়ী একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ব্যাংকের শেয়ার রাখতে পারেন।

তবে লান কাগজে-কলমে নিয়ম মেনে চললেও, বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে ব্যাংকের ৯০ শতাংশ শেয়ার দখল করেন।

এই প্রক্রিয়ায় লান ২০১১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ব্যাংক থেকে ৪৪ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেন।

অর্থ আত্মসাৎ প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন করতে তিনি ব্যাংক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের ঘুষ দেন।

অন্য একটি মামলায় তার বিরুদ্ধে ২৭ বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হয়।

তার বাসা থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার নগদ উদ্ধার হয়।

কঠোর বিচার এবং শাস্তি

ভিয়েতনামের আদালতে ট্রুং মাই লানের বিচার ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।

বিচারের সময় ৮৫ জন অভিযুক্ত, ২৭০০ জন সাক্ষী, এবং ২০০ জন আইনজীবী অংশ নেন।

তার বিরুদ্ধে প্রমাণ উপস্থাপন করতে ১০৪টি বাক্স প্রয়োজন হয়, যার ওজন ছিল ছয় টন।

লানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও, অর্থ ফেরত দিলে সাজা মওকুফের সুযোগ রাখা হয়।

তবে ৯ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে না পারায় আদালত তার আপিল খারিজ করে।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি

বাংলাদেশেও ব্যাংকিং খাতে ভিয়েতনামের মতো লুটপাট ও দুর্নীতির নজির রয়েছে।

সম্প্রতি ২ লাখ কোটি টাকার বেশি অর্থ পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

অর্থ লোপাটের পেছনে সরকারি প্রশাসনের সহযোগিতা ও আইনের ফাঁকফোকর দায়ী।

দেশের ব্যাংক দখল, বেনামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শেয়ার কেনা, এবং ঋণ সীমার ফাঁদ এড়ানোর মতো ঘটনা নিয়মিত।

বাংলাদেশের লোপাট করা অর্থের একটি বড় অংশ যুক্তরাজ্য, কানাডা, এবং মালয়েশিয়ায় পাচার করা হয়।

আইনি দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা

বাংলাদেশে অর্থ আত্মসাত ও মানি লন্ডারিং রোধে প্রচলিত আইনের বেশকিছু ফাঁকফোকর রয়েছে।

বর্তমান আইনে অর্থ আত্মসাতের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মাত্র সাত বছরের কারাদণ্ড।

এ ধরনের অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড কিংবা কঠোর শাস্তি দেওয়ার বিধান নেই।

অর্থ আত্মসাতের পর লোপাট করা অর্থ ফেরত দিলে শাস্তি লঘু করার বিধানও স্পষ্ট নয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব আইনি দুর্বলতার কারণে অপরাধীরা কার্যত রক্ষা পাচ্ছেন।

বাংলাদেশের মানি লন্ডারিং আইন অত্যন্ত জটিল এবং স্পষ্ট নির্দেশনার অভাবে কার্যকর নয়।

ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রে সরাসরি প্রয়োগযোগ্য কোনো আইনের অভাব রয়েছে।

ব্যাংকিং খাতের অপরাধগুলোকে দণ্ডবিধির ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় বিচার করতে হয়, যা অপর্যাপ্ত।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দুর্বলতাও সমস্যাটিকে জটিল করেছে।

দুর্নীতিবিরোধী মামলাগুলোতে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হওয়া সাধারণ ঘটনা।

বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং দুর্বল প্রস্তুতির কারণে বেশিরভাগ মামলাই আদালতে টেকে না।

আইনজীবীরা বলছেন, মানি লন্ডারিং কীভাবে সংজ্ঞায়িত হবে তা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যমান আইনের সংস্কার এবং শাস্তির পরিমাণ বাড়ানো অপরিহার্য।

ভিয়েতনামের মডেল কতটা প্রাসঙ্গিক?

ভিয়েতনামের কঠোর আইন ও শাস্তির ব্যবস্থা বিশ্বের নজর কেড়েছে।

বিশেষ করে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে দেশটির সফলতা অনেকের কাছে উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডসহ কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেই ভিয়েতনাম অর্থনীতি শক্তিশালী করতে পেরেছে।

দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকর ভূমিকা আর্থিক খাতকে সুরক্ষিত রাখতে সহায়ক হয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ভিয়েতনামের মতো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া বাস্তবসম্মত নয়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো এবং আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া ভিয়েতনামের তুলনায় আলাদা।

তবে কঠোর শাস্তির বদলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হলে সুফল আসতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, লুট করা অর্থ জব্দ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফিরিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেষজ্ঞ ও ব্যাংকারদের সুপারিশ

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া ব্যাংক লুটপাট বন্ধ হবে না।

শাস্তির মধ্যে অর্থদণ্ড, সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং আজীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা উচিত।

একই সঙ্গে, অর্থ আত্মসাৎকারীদের সামাজিকভাবে হেয় করার উদ্যোগ নিতে হবে।

অপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তাদের পরিবারকেও আর্থিকভাবে চাপের মুখে ফেলার পরামর্শ দেন তারা।

অপরাধীদের জনসম্মুখে প্রকাশ করে চরমভাবে অপদস্থ করার পদ্ধতি কার্যকর হতে পারে।

অর্থ লুটপাটের ঘটনায় সরকারি প্রশাসন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিরপেক্ষ হওয়া আবশ্যক।

ব্যাংক থেকে অর্থ লুটপাট ঠেকাতে স্বচ্ছ ও শক্তিশালী আইনি কাঠামো গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছেন ব্যাংকাররা।

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে রক্ষায় ব্যাংকিং খাতে সংস্কার এখন সময়ের দাবি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভিয়েতনামের মডেলের কঠোরতা বাংলাদেশে পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

তবে আইন পরিবর্তন ও শাস্তির হার বাড়ানো হলে অর্থ আত্মসাৎ ঠেকানো সহজ হবে।

ভয়, শাস্তি এবং সামাজিক হেয়প্রতিপন্ন করার সম্মিলিত প্রক্রিয়ায় আর্থিক দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব।

আরও পড়তে পারেন