বাংলাদেশ ব্যাংক
,

ব্যাংক খাতের সংকট ও গ্রাহক ভোগান্তি: আমানতকারীদের টাকা কতটা ঝুঁকিতে?

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত সাম্প্রতিক সময়ে এক গভীর সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে কিছু ব্যাংক তারল্য সংকটের কারণে গ্রাহকদের প্রাপ্য পরিমাণ অর্থ সময়মতো প্রদান করতে পারছে না। এতে করে গ্রাহকরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সাম্প্রতিককালে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিস্থিতি এর এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে ব্যাংকের তারল্য সংকটের কারণে গ্রাহকদের প্রত্যাশিত অর্থ উত্তোলন করতে বেগ পেতে হচ্ছে।

মিজ প্রভার অভিজ্ঞতা

মার্জিয়া প্রভা, একজন সাধারণ ব্যাংক গ্রাহক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের রিং রোড শাখায় গিয়ে তাঁর বেতনের টাকা তুলতে যান। কিন্তু সেখানে তাঁকে জানানো হয়, এক দিনে পাঁচ হাজার টাকার বেশি উত্তোলন করা যাবে না। এই ঘোষণা তাঁকে অত্যন্ত বিস্মিত করে, কেননা আগে একই ব্যাংক থেকে তিনি দিনে বিশ হাজার টাকা উত্তোলন করতে পারতেন। এমন পরিস্থিতিতে ম্যানেজারের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে, ম্যানেজার তাকে বলেন, “আপা, আমি পাঁচ হাজার টাকার চেয়ে বেশি দিতে পারবো না, আমাদের তারল্য সংকট চলছে।”

এই পরিস্থিতি শুধু মার্জিয়া প্রভার ক্ষেত্রে নয়, আরও অনেক গ্রাহকের ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। একজন উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত নারী, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, তিনি ১৬ লাখ টাকার একটি এফডিআর (ফিক্সড ডিপোজিট রসিদ) ভাঙাতে গিয়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হন। তিনবার তাঁর পে-অর্ডার বাউন্স করে, যা তাঁকে আরও দুর্বিপাকে ফেলে। ব্যাংক ম্যানেজার তাঁকে আশ্বাস দিলেও তাঁর সমস্যার দ্রুত সমাধান হয়নি। একমাস ধরে ব্যাংকে যাওয়ার পরও তিনি মাত্র দুই লাখ টাকা উত্তোলন করতে সক্ষম হন।

তারল্য সংকটের বাস্তবতা

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ম্যানেজার সালেহ আহমদ বলেন, “আমাদের ব্যাংকে তারল্য সংকট চলছে। আমরা হেড অফিস থেকে পর্যাপ্ত টাকা পাচ্ছি না, ফলে গ্রাহকদের প্রত্যাশিত পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে পারছি না।” এর মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন, যা তারল্য সংকটের মূল কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

ব্যাংকটির নতুন বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান অবশ্য এ সমস্যাকে সাময়িক বলে উল্লেখ করেছেন এবং শীঘ্রই সমাধান হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তবে, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে কতদিন লাগবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

তারল্য সংকটের পেছনের কারণ

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা গেছে যে, বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে তারল্য সংকট বেড়েছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকসহ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এই সংকটের শিকার। এই ব্যাংকগুলোকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা প্রয়োজন বলে জানানো হয়েছে।

এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৭ হাজার ৯০০ কোটি টাকা সহায়তা চেয়েছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সহায়তা পেলেও পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

আস্থার সংকট

ব্যাংক খাতের দুর্নীতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছে। এই দুর্নীতির ফলে অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছে এবং গ্রাহকদের আস্থা কমে গিয়েছে। ফলে গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন, যা সংকট আরও বাড়িয়ে তুলছে। বিশেষ করে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের নতুন বোর্ড চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান বলেন, “ডিপোজিটররাই ব্যাংকের প্রকৃত মালিক। কিন্তু কিছু সংখ্যক লোক এই ব্যাংকগুলোকে দুর্বৃত্তায়িত করেছে এবং এই ব্যাংকগুলোকে কুক্ষিগত করে ফেলেছে। এর ফলেই আজকে এই সংকট তৈরি হয়েছে।” তাঁর মতে, গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে না পারলে সংকট আরও বাড়তে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা

বাংলাদেশ ব্যাংক এই সংকট নিরসনের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। বিশেষ করে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করার জন্য অতিরিক্ত তারল্য থাকা ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ নেয়ার ব্যবস্থা করেছে। তবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্পষ্ট করে বলেছে যে, তারা টাকা ছাপিয়ে এই সংকট সমাধান করবে না। বরং বাজারে থাকা অর্থ দিয়েই এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা চলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, “এই ব্যাংকগুলোকে এক বছরের সময় দিলে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। তবে গ্রাহকরা অপ্রয়োজনে যদি টাকা উত্তোলন করতে থাকেন, তাহলে সংকট আরও বাড়বে।”

দুর্নীতি ও ঋণ সমস্যা

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম ও দুর্নীতি চলে আসছে। বিশেষ করে গত দশ বছরে অনেক ব্যাংক থেকে অনিয়মিতভাবে লোন প্রদান করা হয়েছে, যার অধিকাংশই ফেরত আসেনি। অনেক ঋণগ্রহীতা বিদেশে পালিয়ে গিয়েছেন এবং তাঁদের টাকা পাচার হয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, “অনিয়মের ফলে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়েছে। গ্রাহকদের আস্থা হ্রাস পেয়েছে এবং তার ফলেই আজকের এই পরিস্থিতি।”

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নতুন বোর্ড যৌথভাবে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। তবে, সংকট মোকাবিলায় সময় লাগবে এবং গ্রাহকদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সময়ে ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি, যাতে গ্রাহকরা আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেন এবং তারল্য সংকট দ্রুত সমাধান হয়।

শেষ পর্যন্ত, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধার করা, ব্যাংকিং সেবা উন্নত করা এবং দুর্নীতি বন্ধ করাই হবে এ সংকট থেকে উত্তরণের মূল চাবিকাঠি।

আরও পড়তে পারেন