বিশ্ব ইজতেমা আয়োজন ও কাকরাইল মসজিদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাদ ও জুবায়েরপন্থী দ্বন্দ্ব
ঢাকার উপকণ্ঠে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন ও কাকরাইল মসজিদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা তাবলীগ জামাতের দুই অংশ ‘সাদপন্থী’ ও ‘জুবায়েরপন্থী’।
সংঘাতময় পরিস্থিতি এড়াতে অবশেষে তারা আগের সমঝোতা মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত কয়েকদিন ধরে তাদের অনড় অবস্থান ও পাল্টাপাল্টি ঘোষণার কারণে সহিংসতার আশঙ্কা ছিল।
তবে সমঝোতার আলোকে, দুই অংশই আপাতত নিজেদের অবস্থান থেকে সরতে রাজি হয়েছে বলে জানান তাবলীগ নেতারা।
এই সিদ্ধান্তের ফলে কাকরাইল মসজিদ ভাগাভাগি করে ব্যবহার এবং ইজতেমা দুই পর্বে আয়োজনের আগের সমঝোতা অব্যাহত থাকবে।
তাবলীগের এই দ্বন্দ্বের শুরু ২০১৭ সালে।
তাবলীগের মূল নেতাদের মধ্যে তীব্র মতবিরোধের কারণ ছিল ভারতীয় তাবলীগ নেতা মোহাম্মদ সাদ কান্দালভির কিছু বক্তব্য।
এর পর থেকে সাদপন্থী ও জুবায়েরপন্থী হিসেবে বিভক্ত হয়ে গেছে তাবলীগ জামাত।
বাংলাদেশের তাবলীগ অনুসারীরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে দুই পর্বে আলাদাভাবে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিচ্ছেন।
সাদপন্থীদের প্রতি বিরোধী অংশের কঠোর অবস্থানের কারণে ২০১৮ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমায় মোহাম্মদ সাদ কান্দালভি আর আসতে পারেননি।
সাদপন্থীদের নেতা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম জানান, এবারের ইজতেমায় মি. সাদ কান্দালভিকে আনার জন্য সরকারের সহযোগিতা চাইবেন।
তবে জুবায়েরপন্থী অংশ হেফাজতে ইসলামকে দায়ী করে বলছে, তারা তাবলীগ জামাতের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে।
কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম সব অভিযোগ অস্বীকার করে জানায়, সাদ কান্দালভি ‘নবী রাসুলদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য’ করায় তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নন।
এ বিষয়ে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী জানান, সাদ কান্দালভি ইসলামের বিশ্বাস এবং আকিদার বিপরীত বক্তব্য রেখেছেন, যা ইসলাম সমর্থন করে না।
সংকট নিরসনে আপাতত সংযম
কাকরাইল মসজিদ এবং বিশ্ব ইজতেমার নিয়ন্ত্রণে কে থাকবে তা নিয়ে দু’পক্ষই গত মাসে কঠোর অবস্থান নেয়।
পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ও কর্মসূচি ঘোষণা করায় উত্তেজনা বাড়ে।
তবে সরকার, ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যস্থতায় উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতা স্থাপিত হয়।
তাবলীগের সাদ বিরোধী অংশের নেতা মাহফুজ হান্নান জানান, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আপাতত সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে চলবেন।
প্রতি সপ্তাহের পালাক্রমে দুই পক্ষ কাকরাইল মসজিদ ব্যবহার করে আসছে।
জুবায়েরপন্থী মাহফুজ হান্নান বলেন, ‘আমরা সরকারকে বিব্রত করতে চাই না। আগের নিয়মেই চলতে চাই।’
কাকরাইল মসজিদে শুক্রবার সাদপন্থীদের জমায়েত হওয়ার কথা।
কোনো সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে উভয় পক্ষই একমত বলে জানান তিনি।
কেন দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমা?
১৯৬৭ সাল থেকে বাংলাদেশে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান প্রতি বছর ইজতেমায় অংশ নেন।
২০১৮ সাল থেকে দুই গ্রুপ আলাদা হয়ে দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজন করছে।
প্রথম পর্বে অংশ নেন সাদপন্থীরা, দ্বিতীয় পর্বে জুবায়েরপন্থীরা।
এই বছরও জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ এবং ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দুই পর্বে ইজতেমা হবে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
হেফাজতের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক
সাদপন্থীদের নেতা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ‘তাবলীগের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপনের চেষ্টা করছে হেফাজত।’
তিনি বলেন, ‘তাবলীগের মূল বিতর্কের কারণ হেফাজতের প্রভাব বিস্তার।’
হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতা আজিজুল হক ইসলামাবাদী এ অভিযোগ নাকচ করে বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।’
তার দাবি, সাদ কান্দালভি নবী ও রাসুল নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন।
তাই তিনি বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নন।
মোহাম্মদ সাদ কান্দালভির বিতর্কিত বক্তব্য
মোহাম্মদ সাদ কান্দালভি কিছু বক্তব্যের কারণে তাবলীগের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন।
তার বক্তব্য ছিল, ‘ধর্মীয় প্রচারণা ও শিক্ষা বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করা উচিত নয়।’
তিনি বলেন, ‘মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকরা মাদ্রাসার ভেতর নামাজ না পড়ে মসজিদে এসে নামাজ পড়া উচিত।’
এই মন্তব্যের কারণে সাদপন্থী ও জুবায়েরপন্থীদের মধ্যে বিরোধের শুরু হয়।
কীভাবে এই সংকট সমাধান হবে?
জুবায়েরপন্থীদের দাবি, সাদপন্থীদের কাকরাইল মসজিদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক।
সাদপন্থীরা বলছেন, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং কোনো সংঘাত চান না।
অবশেষে সরকার ও প্রশাসনের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষই সংযত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে তাবলীগের এই বিভক্তি দীর্ঘমেয়াদে কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে।
তাবলীগের দুই অংশের দ্বন্দ্বের ফলে বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
বিশ্ব ইজতেমা ও তাবলীগ জামাতের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে।