দেশের বিদ্যুৎ খাতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিশেষ আইনের মাধ্যমে করা শতাধিক চুক্তি ও প্রকল্পের বিষয়গুলো নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এসব প্রকল্পের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রায় পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো।
ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কখনও কারো কাছে হস্তান্তর করেননি। এর ফলে এই খাতের বিশাল বাজেট ও প্রকল্পগুলো একচেটিয়া সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে।
চুক্তি ও প্রকল্পের পুরো নিয়ন্ত্রণ প্রধানমন্ত্রীর হাতে
বিদ্যুৎ খাতে বিগত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে টেকনিক্যাল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ছিল মূল কেন্দ্র।
তবে এই সংস্থার সিদ্ধান্তের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হতো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকল্প পাস করানো এবং কাজ বণ্টনে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব পছন্দের আমলাদের ব্যবহার করতেন।
বিশাল আর্থিক লেনদেন ও কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে এসব চুক্তির পেছনে।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর আওতায় রাখার কারণ
বিদ্যুৎ খাতকে টেকনিক্যাল ও অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় হিসেবে বিবেচনা করে আওয়ামী লীগ সরকার এটি প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই রেখেছিল।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিক প্রতিমন্ত্রীকে সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিলেও চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের একজন সাবেক কর্মকর্তা বলেন, এই মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোতে প্রচুর অর্থের সংশ্লিষ্টতা থাকায় ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা এটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেন।
এ কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নীতি বা নিয়ম লঙ্ঘনেরও অভিযোগ রয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতির অভিযোগ
বিদ্যুৎ খাতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নেয়া বিশেষ আইনের মাধ্যমে দ্রুত প্রকল্প অনুমোদনের সুযোগ তৈরি হয়।
এই আইনের আওতায় পছন্দের কোম্পানিগুলোকে চুক্তি দেয়া হতো।
বিদ্যুৎ খাতের নীতিমালা লঙ্ঘন করে অনেক চুক্তি বাস্তবায়নের অভিযোগ করেছে বিরোধী দল বিএনপি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি, চুরি ও অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগ সরকার এই মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল।
চুক্তিগুলো রিভিউ করার প্রতিশ্রুতি বিএনপির
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বিদ্যুৎ খাতের সব চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা হবে বলে জানিয়েছে দলটি।
বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেছেন, বিদ্যুৎ খাতের চুক্তিগুলো জনসাধারণের কাছে উন্মুক্ত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ব্যবস্থা নেয়া।
তিনি বলেন, এ খাতে লুকোচুরি আর অব্যবস্থাপনার অবসান ঘটানো প্রয়োজন।
বিদ্যুৎ খাতের নীতি নির্ধারণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে টেকনিক্যাল দক্ষ নেতৃত্ব আনার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিবেশী দেশগুলোয় ভিন্ন বাস্তবতা
বিদ্যুৎ খাতকে প্রধানমন্ত্রীদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টি বাংলাদেশে দৃষ্টান্তমূলক হলেও প্রতিবেশী দেশগুলোতে তেমনটি দেখা যায়নি।
ভারতে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন একজন আলাদা মন্ত্রী।
নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানেও বিদ্যুৎ খাত পরিচালনার দায়িত্ব আলাদা মন্ত্রী বা টেকনোক্র্যাটদের হাতে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের কারিগরি খাতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিলে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হবে।