বাংলাদেশের বিজয় দিবসকে ভারতের বিজয় হিসেবে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির টুইট ঘিরে দেশে-বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হলেও বিষয়টিতে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাবে না বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে দেখছে এবং এ নিয়ে ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসকে তলব বা প্রটেস্ট নোট পাঠানোর কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, “তিনি তার মতো করে বলেছেন, আমরাও আমাদের মতো করে বলবো।”
‘মোদির বক্তব্য রাজনৈতিক’ বলে ইগনোর নীতি
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিজয় দিবসের সকালে মোদির টুইট নিয়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়েছে এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
এ নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানালে তা কূটনৈতিক সম্পর্কে অপ্রত্যাশিত টানাপোড়েন তৈরি করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “বিজয় দিবসের বিষয়ে ভারতের বার্তা প্রতি বছরই এমন থাকে। তবে এবারের মতো করে সরাসরি ভারতের বিজয় উল্লেখ করা কিছুটা ব্যতিক্রম।”
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, “ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাই নেইম শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এটি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আমরা আমাদের মতো করেই দেখছি।”
মোদির টুইট এবং বাংলাদেশের অনুপস্থিতি
১৬ ডিসেম্বর সকালে নরেন্দ্র মোদি একটি টুইট বার্তায় লেখেন, “আজকের এই বিজয় দিবসে, সেইসব নির্ভীক সেনাদের সম্মান জানাই যারা ১৯৭১ সালে ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়ে অবদান রেখেছিল।”
মোদির ওই টুইটে কোথাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা বিজয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়নি।
প্রতি বছরই বিজয় দিবস উপলক্ষে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানানো হলেও এবারের টুইট বার্তা বিশেষভাবে বাংলাদেশে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারতের শুভেচ্ছা বার্তাগুলো অধিকতর কূটনৈতিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ ছিল।
২০২১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে দেওয়া বার্তায় মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনাদের উল্লেখ করেছিলেন মোদি।
সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া এবং রাজনৈতিক প্রতিবাদ
নরেন্দ্র মোদির টুইটের পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশিদের তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়।
মুজাহিদ শুভ নামে একজন মন্তব্য করেন, “ফ্যাব্রিকেটেড হিস্ট্রি।”
আরেকজন ব্যবহারকারী লেখেন, “ইট ওয়াজ আওয়ার ভিক্টোরি। উই আর বাংলাদেশি।”
সরকার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ফেসবুকে লিখেন, “এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, যা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য সংঘটিত হয়েছিল।”
তিনি মোদির বক্তব্যকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেন।
বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও বিষয়টি নিয়ে সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল টুইটটি “তীব্র প্রতিবাদযোগ্য” হিসেবে আখ্যা দেন এবং বলেন, “১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের দিন, ভারত মিত্র ছিল, এর বেশি কিছু নয়।”
ইতিহাসের প্রেক্ষাপট: কার বিজয়?
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং বাংলাদেশ-ভারত মিত্র বাহিনীর যৌথ বিজয় ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।
কিন্তু বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশ মনে করেন, এ বিজয় কোনো দেশের একক অর্জন নয়।
সাবেক সাংবাদিক এবং রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারি লিখেছেন, “আমাদের বিজয় কেউ সোনার থালায় উপহার দেয়নি। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা।”
তিনি আরো বলেন, “বাংলাদেশের বিজয় অন্য কোনো দেশের কাছে বর্গা দেওয়া নয়।”
মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের মতে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের ঘটনাটি একদিকে যেমন পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয়, তেমনই ভারতের জন্য এটি একটি কৌশলগত ও সামরিক সাফল্য।
তবে বিজয়ের প্রকৃত অর্থ এবং তা কাদের নামে লেখা হবে, তা নিয়ে দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গি বরাবরই কিছুটা ভিন্ন।
বাংলাদেশ কেন ইগনোর করছে?
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান সরকারের নীতিগত অবস্থান হলো বড় কূটনৈতিক টানাপোড়েন এড়িয়ে চলা।
বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এমন কোনো মন্তব্য বা পদক্ষেপ নিতে চায় না বাংলাদেশ, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, “মোদির বক্তব্যে কোনো অস্বাভাবিক কিছু নেই। প্রতিবাদ করা বা তলব করার মতো অবস্থান নেয়া প্রয়োজন মনে হয়নি।”
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন বিষয়গুলোতে বাংলাদেশে একটি আনুষ্ঠানিক বার্তা প্রয়োজন, যাতে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা হয় এবং জাতীয় অহংকারও অক্ষুণ্ণ থাকে।