১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত ছিল অন্যতম প্রধান মিত্র।
ভারতের সরাসরি সামরিক অংশগ্রহণ এবং কূটনৈতিক চাপ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল।
ভারতের সহায়তায় তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা।
এ সম্পর্কের ভিত্তি ছিল পারস্পরিক সহযোগিতা, বন্ধুত্ব এবং আস্থা।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করে।
বিগত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এক বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছানোর কথা বলা হলেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন।
কূটনৈতিকভাবে বন্ধুত্বের বার্তা দেওয়া হলেও সীমান্ত হত্যা, পানি বণ্টন, বাণিজ্য বৈষম্য এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতীয় হস্তক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ছিল দীর্ঘদিনের।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
এরপর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক আরও সংকটের মুখে পড়ে।
ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক আলোচনার জায়গা সংকুচিত হতে শুরু করে।
বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন সরকারের ভারতের প্রতি মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
নতুন সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নের কথা জানায়।
ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ে হামলা এই সংকটকে আরও গভীর করে তোলে।
হামলার সময় জাতীয় পতাকা পোড়ানোর ঘটনাকে বাংলাদেশ সরকার সরাসরি তাদের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হিসেবে দেখেছে।
এই ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে আস্থার সংকট আরও তীব্র হয়েছে।
বাংলাদেশের জনপর্যায়ে ভারতকে নিয়ে ক্ষোভ এখন প্রকাশ্য।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের কথা বলা হলেও ভারতের ভূমিকা নিয়ে শঙ্কা কমেনি।
অতীতের বন্ধুত্ব আজ ঐতিহাসিক স্মৃতিতে রয়ে গেছে।
বর্তমান বাস্তবতা দুই দেশের সম্পর্ককে নতুনভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করেছে।
দুই দেশের মধ্যে স্থিতিশীলতা আনতে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন এখন সময়ের দাবি।
ভারতের উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভারতের জন্য সবসময়ই স্পর্শকাতর বিষয়।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত ভাগ করে।
এই অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা ভারতের অন্যতম প্রধান উদ্বেগ।
বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের পর ভারত অভ্যন্তরীণভাবে বিভিন্ন বার্তা পেয়েছে যা তাদের অস্বস্তি বাড়িয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানের সময় এবং পরবর্তী সময়ে ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে সরাসরি হুমকি দেওয়া হয়।
সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত এই হুমকিগুলো ভারতীয় প্রশাসনের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়েছে।
ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা মনে করেন, অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তারা এখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না।
ভারতের অন্যতম কূটনৈতিক বিশ্লেষক শ্রীরাধা দত্ত বলেছেন, বর্তমান সরকার ভারত-বাংলাদেশ ঐতিহাসিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
তিনি উল্লেখ করেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আগে ২০০১-০৬ সময়কালে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক অত্যন্ত নাজুক ছিল।
সে সময় ভারতের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সহিংস কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছিল বাংলাদেশ থেকে।
ভারতের উদ্বেগ আরও গভীর হয়েছে যখন দেখা গেছে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।
পাকিস্তানের পণ্যবাহী জাহাজ সরাসরি বাংলাদেশে আসা শুরু করেছে।
শত বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো জিন্নাহর জন্মদিন উদযাপন বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্বের ইঙ্গিত দিয়েছে।
এ ঘটনাগুলো ভারতের নিরাপত্তা নীতির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের সহযোগিতাকে ভারতের নীতি নির্ধারকরা তাদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন।
ভারতের গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে নানা তথ্য ও গুজব ছড়াচ্ছে।
তবে বাংলাদেশ সরকার এসব গুজবকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
ভারতীয় কূটনীতিকরা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনলে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
ভারতের জন্য বাংলাদেশ শুধু ভৌগোলিক সীমান্তের একটি অংশ নয়, এটি ভারতের ভূরাজনীতি এবং অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য।
বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের প্রতি ভারতের অস্বস্তি স্পষ্ট।
ভারতের পক্ষ থেকে বারবার কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করা হলেও বাংলাদেশে এই বার্তা তেমন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পায়নি।
দুই দেশের মধ্যকার এই আস্থার সংকট উত্তেজনার জায়গা তৈরি করেছে যা পারস্পরিক স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
বাংলাদেশের প্রতিবাদ ও কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া
ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ে হামলার ঘটনাটি বাংলাদেশের জন্য গভীর কূটনৈতিক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এই ঘটনার বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে আনুষ্ঠানিক নোট দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই হামলাকে সার্বভৌমত্বের প্রতি সরাসরি আঘাত হিসেবে উল্লেখ করেছে।
জাতীয় পতাকা পোড়ানোর ঘটনাকে তারা “গুরুতর অপমান” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
এই ঘটনার পর বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়।
ঢাকায় শাহবাগে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতৃত্বে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে।
বিক্ষোভকারীরা সীমান্ত হত্যা, পানি বণ্টন এবং ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন দাবি করেছেন, “ভারত বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ বন্ধ না করলে সম্পর্ক আরও অবনতি হতে পারে।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন।
তিনি বাংলাদেশের মর্যাদা রক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে বলেছেন।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতের এই আচরণ দুই দেশের ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব নষ্ট করছে।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিষয়টি তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাসের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশের উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
বিশেষ করে জাতিসংঘ এবং ওআইসির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রস্তুতি চলছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, “ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই, তবে তা অবশ্যই সম্মানজনক হওয়া প্রয়োজন।”
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকার আগরতলায় হামলার নেপথ্যে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে ভারতের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে প্রস্তুত।
তবে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে তা দীর্ঘমেয়াদে সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি
ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন কেবল কূটনৈতিক সীমায় নয়, সাধারণ মানুষের পর্যায়েও অবনতির মুখে পড়েছে।
সাম্প্রতিক ঘটনার পর ভারতে বাংলাদেশিদের প্রতি বৈরী আচরণের খবর পাওয়া গেছে।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে হোটেলে বাংলাদেশি পর্যটকদের থাকতে দেওয়া হয়নি।
ভারতীয় সীমান্তের কাছে স্থানীয় বাসিন্দারা বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ করেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদী বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশেও ভারতের পণ্য বর্জনের আহ্বান দেখা গেছে।
ঢাকায় বিক্ষোভকারীরা ভারতের আগ্রাসী আচরণের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছে।
তারা দাবি করেছে, “ভারতের সাথে সমান সমান সম্পর্ক চাই, আধিপত্য নয়।”
এই বিক্ষোভে ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকদেরও অংশ নিতে দেখা গেছে।
ভারতের জনগণের মধ্যেও বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব বাড়ছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার মিথ্যা খবর ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সাবেক কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবির বলেছেন, “দুই দেশের জনগণের মধ্যে এই উত্তেজনা নজিরবিহীন।”
তিনি সতর্ক করেছেন যে এই ধরনের মনোভাব ভবিষ্যতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।
ভারত ও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে গভীর।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি এই সম্পর্কের ওপর বড় ধরনের আঘাত হেনেছে।
বিশেষ করে বাণিজ্যিক, পর্যটন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দুই দেশের সরকার যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়, তবে জনগণের মধ্যে এই শত্রুতা আরও তীব্র হতে পারে।
আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগের ঘাটতি এবং এর প্রভাব
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ বর্তমানে স্থবির অবস্থায় রয়েছে।
৫ আগস্টের পরবর্তী সময় থেকে দুই দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা বন্ধ রয়েছে।
এই পরিস্থিতি দুই দেশের সম্পর্কের জন্য উদ্বেগজনক।
অতীতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক চ্যানেল ছিল অত্যন্ত সক্রিয়।
দুই দেশের কর্মকর্তারা নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করতেন।
কিন্তু বর্তমানে সেই উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ঘাটতির ফলে ভুল বোঝাবুঝি আরও বাড়ছে।
ভারতের কূটনীতিকরা বলছেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার থেকে সঠিক বার্তা পাচ্ছেন না তারা।
বাংলাদেশও বলছে, ভারতীয় পক্ষ থেকে তারা ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছে না।
এই পরিস্থিতি বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপরও প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের রপ্তানি কমতে শুরু করেছে।
ভারতে বাংলাদেশের পণ্যবাহী ট্রাক সীমান্তে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
দুই দেশের মধ্যে ভিসা পরিষেবাও কার্যত বন্ধ রয়েছে।
ভারতীয় ভিসা বন্ধের ফলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশও তাদের আগরতলা মিশনের কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
দুই দেশের সরকার যদি আলোচনায় না বসে, তবে এই অবস্থা আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আন্তঃনির্ভরতা উভয় পক্ষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান বাস্তবতায় দুই দেশের সম্পর্ককে পুনর্গঠনের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।
বিশেষ করে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে আস্থার সংকট দূর করা উচিত।
কিন্তু তার আগে দুই দেশের নেতাদের জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ কমাতে উদ্যোগ নিতে হবে।