২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে আন্তর্জাতিক সাইবার অপরাধীদের একটি চক্র বাংলাদেশের জনগণের কষ্টার্জিত রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৬২৩ মার্কিন ডলার লুট করে।
এই ঘটনা ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট হ্যাকের মাধ্যমে।
তদন্তে জানা যায়, এই অপরাধ সংঘটনে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তত দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের কর্মকর্তারা সরাসরি সহায়তা করেন।
হ্যাকিংয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘আরটিজিএস’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, যার মাধ্যমে সুইফট সিস্টেমের নিরাপত্তা ভেঙে চুরি করা সম্ভব হয়।
অভিযোগ ওঠে, তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান এই ঘটনা ২৪৪ দিন গোপন রাখেন।
অন্যদিকে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতেও অনুমতি দেননি।
সুইফট বার্তার মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের নীলনকশা
তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকেই সাইবার অপরাধীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সিস্টেমে প্রবেশের পরিকল্পনা শুরু করে।
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে সুইফট সিস্টেমে ম্যালওয়ার প্রবেশ করানো হয়, যা পরে হ্যাকিংয়ে ব্যবহার করা হয়।
হ্যাকিংয়ের দিন, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি, সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে সুইফট সিস্টেম থেকে ১৮টি অনুমোদিত পেমেন্ট ইনস্ট্রাকশন পাঠানো হয়।
এরপর রাত ৮টা ৩৬ মিনিট থেকে ভোর ৩টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত ৩৫টি অননুমোদিত বার্তা প্রেরণ করা হয়।
এই বার্তাগুলোর মাধ্যমে মোট ৯৫ কোটি ডলারের পেমেন্ট ইনস্ট্রাকশন পাঠানো হয়, যার মধ্যে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনের মাকাতি শাখার আরসিবিসি ব্যাংকের ভুয়া অ্যাকাউন্টে জমা হয়।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ৩০টি পেমেন্ট স্থগিত করলেও পাঁচটি অননুমোদিত পেমেন্ট বাস্তবায়িত হয়।
আরসিবিসি ব্যাংকে স্থানান্তরিত অর্থের রহস্য
তদন্তে উঠে এসেছে, আরসিবিসি ব্যাংকের মাকাতি শাখা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের স্টপ পেমেন্ট বার্তাগুলো উপেক্ষা করে অর্থ স্থানান্তর করে।
এই অর্থ পরবর্তীতে ক্যাসিনো ও জাঙ্কেট অপারেটরদের মাধ্যমে লন্ডভন্ড হয়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে ফিলিপাইন সরকারকে বিষয়টি সময়মতো জানানো হয়নি।
এমনকি, ফিলিপাইনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে অর্থ উদ্ধারের সম্ভাবনাও হাতছাড়া হয়।
এখন পর্যন্ত চুরি যাওয়া অর্থ থেকে মাত্র ১৮ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদন ও অপরাধীদের দায়মুক্তি
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা চিহ্নিত করে।
তদন্তে ব্যাংকের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়।
তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়, জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে।
তবে, আট বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো অপরাধীদের সহায়তা করেছে এবং সিস্টেমের গোপন তথ্য সাইবার অপরাধীদের কাছে সরবরাহ করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
অর্থমন্ত্রী ও সরকারের ভূমিকায় প্রশ্ন
তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একাধিকবার বলেছিলেন, তদন্ত রিপোর্ট জনগণকে জানানো হবে।
তবে পরে এই রিপোর্ট গোপন রাখা হয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হলেও অগ্রগতি তেমন হয়নি।
এফবিআই-এর এক তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, রাষ্ট্রীয় সহায়তা ছাড়া এত বড় চুরি সম্ভব ছিল না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা দেশের জনগণের অর্থ লুটের এক চরম উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।