বাংলাদেশে নিজেদের একটি ব্যাংকের শাখা খোলার আগ্রহ প্রকাশ করেছে রাশিয়া।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ঋণের কিস্তির অর্থ নিজেদের জিম্মায় নিতে এই উদ্যোগ নিতে চায় রুশ কর্তৃপক্ষ।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় সুইফট সিস্টেম থেকে রাশিয়ার কিছু ব্যাংককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ফলে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ার ঋণের অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতা কাটাতে নতুন এই প্রস্তাব সামনে এনেছে দেশটি।
গত তিন মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এই ইস্যুতে আলোচনা করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি।
ঋণের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ শুরু হয়েছে।
তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি অর্থ রাশিয়ায় পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না।
ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ স্ক্রু অ্যাকাউন্টে এই অর্থ জমা রাখা হচ্ছে।
এই অ্যাকাউন্টে এখন পর্যন্ত ৬৩ কোটি ডলার জমা হয়েছে, যা প্রতিবছর দুই কিস্তিতে জমা দেওয়া হচ্ছে।
রাশিয়া এই অর্থ নিজেদের জিম্মায় নিতে চায় এবং এজন্য বিকল্প পথ খুঁজছে।
চীনা ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের প্রস্তাব
গত আগস্টে রাশিয়া বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেয়, স্ক্রু অ্যাকাউন্টে জমা থাকা অর্থ যেন চীনের একটি ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয়।
তবে বাংলাদেশ এই প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি।
পরবর্তীতে রাশিয়া বাংলাদেশে একটি ব্যাংক শাখা খোলার জন্য সরকারের অনুমতি চায়।
রূপপুর ঋণ চুক্তিতে ব্যাংক শাখার বিষয়টি
রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ঋণ চুক্তিতে ব্যাংক শাখা খোলার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তবে চুক্তি সত্ত্বেও ব্যাংক শাখা খোলার অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এবং রাজনৈতিক বাস্তবতাগুলো বড় প্রভাব ফেলছে।
বিশ্লেষকদের সতর্কতা
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত কোনো ব্যাংকের শাখা ঢাকায় খোলা হলে আন্তর্জাতিক আইনগত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন, রাশিয়া কোন ব্যাংকের শাখা খোলার প্রস্তাব দিচ্ছে, তার ওপর বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে।
ঋণের অর্থ যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের জিম্মায় নিতে চাওয়াটা রাশিয়ার স্বাভাবিক চাওয়া বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ঋণ পরিশোধ নিয়ে জটিলতা
রূপপুর প্রকল্পে রাশিয়ার দেওয়া ঋণের অর্থ পরিশোধের বিষয়টি এখন দর-কষাকষির পর্যায়ে রয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজেও ধীরগতি দেখা দিয়েছে।
অগাস্ট মাসে বাংলাদেশ সরকার ঋণের আসল পরিশোধ দুই বছর পিছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করে।
রাশিয়া এতে সম্মত হলেও এর বিপরীতে তাদের নিজস্ব কিছু শর্ত সামনে আনে।
চীনের ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরের অনুরোধ
রাশিয়ার অন্যতম শর্ত ছিল ঋণের সুদ পরিশোধের অর্থ চীনের একটি ব্যাংকে পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশ এই শর্তে সাড়া না দেওয়ায় রাশিয়া বিকল্প হিসেবে ব্যাংক শাখা খোলার প্রস্তাব সামনে আনে।
এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় ঋণের আসল পরিশোধ পিছিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও ঝুলে আছে।
ঋণের বিস্তারিত
২০১৬ সালে রূপপুর প্রকল্পের জন্য রাশিয়ার এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তি করে বাংলাদেশ।
এই প্রকল্পে রাশিয়া ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে।
২০১৭ সালে এই ঋণের অর্থ প্রদান শুরু হয়।
১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষে ২০২৭ সালের ১৫ মার্চ থেকে ঋণের মূল কিস্তি পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা।
প্রতিবছর ছয় মাস পরপর দুই কিস্তিতে মোট ৩৮ কোটি ডলার আসল পরিশোধ করতে হবে।
এর সঙ্গে প্রতি কিস্তিতে ১১ কোটি ডলার সুদ দিতে হবে, যা সময়ের সঙ্গে বাড়তে বা কমতে পারে।
রূপপুর প্রকল্পে বিলম্ব
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা ছিল।
তবে কাজে বিলম্ব হওয়ায় এটি শেষ হতে আরও দুই বছর সময় লাগবে।
এই বিলম্বের কারণে প্রকল্পের মোট খরচও বেড়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অর্থনীতি নিয়ে সরকারের পর্যালোচনা
রূপপুর প্রকল্পের ঋণ চুক্তি এবং ব্যয় পর্যালোচনা করতে সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছে।
এই পর্যালোচনা রাশিয়ার জন্যও কিছুটা অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক চাপ ও ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে চাপ রয়েছে, যাতে তারা কোনো নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন না করে।
এদিকে রাশিয়া তাদের অর্থ দ্রুত এবং কার্যকর উপায়ে আদায়ে আগ্রহী।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ও রাশিয়া উভয় পক্ষের জন্য এমন একটি সমাধান দরকার, যা আন্তর্জাতিক আইনসম্মত এবং বাস্তবসম্মত।
সরকার এই বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না দেওয়ায় রাশিয়ার প্রস্তাব বাস্তবায়নের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত রয়ে গেছে।