বাংলাদেশে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রণীত ও মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিলের পর তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। তবে এই কমিটি বাতিলের কারণ সম্পর্কে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা আসেনি।
গত শনিবার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত এ কমিটি হঠাৎ করেই বাতিল করা হয়। এনসিটিবি এবং মন্ত্রণালয় উভয়ই এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো কারণ উল্লেখ করেনি। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে নানা প্রতিক্রিয়া আসছে। বিশেষত, সামাজিক মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবীরা একদিকে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলো সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে।
বিতর্কের সূচনা
গত পনেরই সেপ্টেম্বর এনসিটিবি কর্তৃক পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের জন্য একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন ও অধ্যাপক সামিনা লুৎফা। তবে কমিটি গঠনের পর থেকেই ধর্মভিত্তিক কিছু সংগঠন এবং মাদ্রাসা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মহল থেকে এই দুজন সদস্যের ওপর আপত্তি তোলা হয়। তাদের ধর্মবিদ্বেষী আখ্যা দিয়ে ওই কমিটি পুনর্গঠনের দাবি তোলে এসব সংগঠন।
এরপর, কিছু ধর্মভিত্তিক দল ও ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যমে এবং জনসভায় কমিটির ওপর আক্রমণ করতে থাকে। তাদের মতে, কমিটিতে থাকা কিছু সদস্যের ‘ধর্মবিদ্বেষী’ বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের কারণে তারা ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারেন। বিশেষত, হেফাজতে ইসলাম, খেলাফত মজলিসের মতো সংগঠনগুলো এসব অভিযোগ উত্থাপন করে।
হেফাজতে ইসলামের অবস্থান
হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী এ বিষয়ে বলেন, “এখানে এমন কিছু লোককে রাখা হয়েছিল যারা ইসলাম বিদ্বেষী এবং নাস্তিকতা লালন করেন। তাদের দ্বারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন হতে পারে না।” তিনি আরো বলেন যে, শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামি মূল্যবোধ গুরুত্ব পাবে না কেন, এ বিষয়ে তাদের প্রশ্ন রয়েছে।
এর আগে, খেলাফত মজলিসের নেতা মামুনুল হক একটি জনসভায় এ বিষয়ে প্রকাশ্যে আপত্তি জানান এবং অভিযোগ করেন যে, “শিক্ষা কমিশনের মধ্যে এমন কিছু সদস্য রয়েছেন যারা সমকামিতার প্রমোটকারী।”
সমালোচকদের প্রতিক্রিয়া
কমিটি বাতিলের খবর আসার পর এক পক্ষ সরকারের সমালোচনায় সরব হয়ে ওঠে। বিশেষ করে শিক্ষা ও বুদ্ধিজীবী মহল থেকে এ নিয়ে অসন্তোষ দেখা যায়। অনেকেই মনে করছেন, ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর চাপে নতি স্বীকার করেই সরকার এ কমিটি বাতিল করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ মনে করেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোকে প্রশ্রয় দিয়ে আসছে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে ধর্মান্ধদের হাতে তুলে দিয়ে নিজেদের অবস্থান দুর্বল করেছে। ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে সরকার যে প্রশ্রয় দিচ্ছে, তা দেশের ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থার জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।”
পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের ইতিহাস
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রভাব নতুন কিছু নয়। ২০১৭ সালে হেফাজতে ইসলামসহ কিছু ধর্মভিত্তিক সংগঠনের চাপে পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছিল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি গল্প সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে আরও অনেক সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুকে পাঠ্যপুস্তক থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর থেকে শিক্ষা ও কারিকুলাম নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে।
এ বছরও সপ্তম শ্রেণির বই থেকে ‘শরীফার গল্প’ নামের একটি পাঠ্যবই সরিয়ে নেয়া হয়, যেখানে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবন ও সমস্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। সেই সময়ও ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর দাবি মেনে নিয়ে এই পদক্ষেপ নেয় সরকার।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থান
পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটি বাতিলের বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, “এখন কমিটি বাতিল হয়েছে, তবে পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের কাজ তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। আমাদের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকরা পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের কাজ শেষ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।”
তবে কমিটি বাতিলের সিদ্ধান্তের পেছনে প্রকৃত কারণ কী, তা তিনিও জানেন না বলে মন্তব্য করেন।
অন্যদিকে, কমিটির সদস্য অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। অধ্যাপক সামিনা লুৎফাও এই বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি।
শিক্ষাবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি
শিক্ষাবিদদের একাংশ মনে করছেন, এই ধরনের পদক্ষেপ শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্মীয় গোষ্ঠীর চাপে পরিচালিত করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে, যা শিক্ষার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান মনে করেন, “এই ধরনের কমিটি বাতিল করার মাধ্যমে শিক্ষার প্রতি অবজ্ঞা ফুটে উঠছে। শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে সব ছাত্রছাত্রীদের উপযোগী, যেখানে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং বিশ্বনাগরিকত্বের শিক্ষা থাকবে।”
তিনি আরো বলেন, “শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো চাপ বা আপোষ মেনে নিলে শিক্ষার গুণগত মান কমে যাবে এবং শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে নিজেদের উপযুক্ত করে তুলতে পারবে না।”
ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার অভিমুখ
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বর্তমানে যেসব পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব ও চাপে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন এবং কমিটি বাতিলের সিদ্ধান্তকে অনেকেই শিক্ষার মূলধারার বিপরীত বলে মনে করছেন।
শিক্ষাবিদদের মতে, শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের চিন্তাশীল ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। আর এ জন্য প্রয়োজন একটি বহুমুখী ও বৈচিত্র্যময় কারিকুলাম, যেখানে ধর্মীয়, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সমন্বয় থাকবে।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে শিক্ষার ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে। কারিকুলাম বা পাঠ্যপুস্তক নিয়ে এই ধরনের বিতর্ক শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান ও ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।