,

বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস: শ্রীলংকা না তিউনিশিয়ার পথে?

গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে শিক্ষার্থী-নেতৃত্বাধীন এক ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার সরকার পতন ঘটে।

তৎপরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পাঁচ মাস পেরোলেও জনজীবনে আশানুরূপ কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা—সবক্ষেত্রেই সংকট অব্যাহত।

পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, এই পাঁচ মাসে সারা দেশে ১,৩৬১টি খুন ও ২৫৫টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও বিদ্যমান, যেখানে বড় দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী একে অপরের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও ব্যাংক দখলের অভিযোগ তুলছে।

শ্রীলংকার সাফল্য: দুই বছরের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ানোর নজির

২০২২ সালে গোতাবায়া রাজাপাকসে সরকারের পতনের পর শ্রীলংকা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে পেতে সক্ষম হয়।

তৎকালীন সরকারের সময় ৬৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি এবং ৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাওয়া রিজার্ভের মুখোমুখি হওয়া দেশটি মাত্র দুই বছরের মধ্যেই দৃঢ়ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমানে শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি ঋণাত্মক ২.১০ শতাংশে নেমেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৫ বিলিয়ন ডলারে।

শ্রীলংকার সাম্প্রতিক পার্লামেন্ট নির্বাচনে বামপন্থী ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, যা দেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছে।

তিউনিশিয়ার পথে বাংলাদেশ?

২০১১ সালের জেসমিন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তিউনিশিয়ায় স্বৈরশাসক জাইন আল আবেদিন বেন আলি ক্ষমতাচ্যুত হন।

কিন্তু ১৩ বছর পরেও দেশটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার চক্র থেকে বের হতে পারেনি।

উচ্চ বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি এবং দুর্বল রিজার্ভের কারণে দেশটি এখনও সংকটে রয়েছে।

তিউনিশিয়ার মতো বাংলাদেশেও অন্তর্বর্তী সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

দেশে গ্যাস অনুসন্ধান এবং বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রচেষ্টা এখনও কোনো উল্লেখযোগ্য ফল দেয়নি।

বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি গত বছরের তুলনায় ৯১ শতাংশ কমেছে, এবং ঋণ পরিশোধে বরাদ্দ অর্থ ছাড় হয়েছে তার চেয়ে বেশি।

অর্থনীতি ও রাজনীতির জটিল সংকট

বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ, যা নভেম্বর মাসে ১১.৩৮ শতাংশে পৌঁছেছে।

খাদ্য মূল্যস্ফীতি এই সময়ে প্রায় ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সুদহার বাড়ানোর মতো উদ্যোগ নিলেও এর বাস্তবায়নে তেমন সফলতা আসেনি।

রাজনৈতিক দিক থেকেও দেশের বিভাজন স্পষ্ট, যেখানে জাতীয় নির্বাচন এবং ক্ষমতার ধরন নিয়ে বিতর্ক চলছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন সরকারের মধ্যেও দ্বন্দ্বের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

শিক্ষার্থী আন্দোলন থেকে প্রত্যাশা

শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল বৈষম্য ও দুর্নীতির অবসান ঘটানো।

কিন্তু এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার সেই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।

অর্থনীতিবিদদের মতে, গত ১৫ বছরে দেশে সুশাসনের অভাব এবং দুর্নীতির বিস্তারই বর্তমান সংকটের মূলে।

তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পুনর্গঠিত আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়েই দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানী সামিনা লুৎফা।

অর্থনীতির মৌলিক সূচকগুলো স্থিতিশীল করতে না পারলে ভবিষ্যতে দেশের পরিণতি তিউনিশিয়ার মতো হতে পারে, এমন আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়তে পারেন