,

বাংলাদেশে ইসকন নিয়ে বিতর্ক: সংঘের কার্যক্রম, মতবাদ ও অভিযোগের বিশ্লেষণ

ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন) ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সংগঠন।

সংগঠনটি গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মীয় মতাদর্শের প্রচারে কাজ করে।

ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা এসি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ।

তিনি ভারতীয় ধর্মীয় ঐতিহ্যের মূল বার্তা বিশ্বের কাছে পৌঁছানোর জন্য জীবনের শেষ দিকে এই সংগঠন গড়ে তোলেন।

কলকাতায় জন্মগ্রহণকারী এসি ভক্তিবেদান্ত তার জীবনের অধিকাংশ সময় হিন্দু ধর্মের বৈষ্ণব মতবাদ নিয়ে গবেষণা এবং লেখালেখিতে ব্যয় করেন।

১৯৬৫ সালে, প্রায় ৭০ বছর বয়সে, তিনি একটি মালবাহী জাহাজে চেপে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান।

তার সঙ্গে ছিল মাত্র সাত ডলার এবং কয়েকটি বই।

পরের বছরই নিউ ইয়র্কে ইসকনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।

মাত্র এক দশকের মধ্যে তিনি বিশ্বের বহু দেশে ইসকনের কার্যক্রম বিস্তৃত করেন।

তার জীবদ্দশায় ইসকন প্রায় ১০০টি দেশে পৌঁছে যায়।

প্রভুপাদ ৪০টিরও বেশি ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করেন, যা ইসকনের আধ্যাত্মিক পথচলার মূলভিত্তি।

তার মৃত্যুর পরও সংগঠনটি একই উৎসাহে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমানে ইসকনের পাঁচশোটিরও বেশি কেন্দ্র রয়েছে।

এছাড়াও, অসংখ্য মন্দির, স্কুল, এবং স্থানীয় গোষ্ঠীর মাধ্যমে ইসকনের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার মায়াপুরে ইসকনের প্রধান কেন্দ্র অবস্থিত।

এই মায়াপুরই চৈতন্যদেবের জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত, যিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদের প্রবক্তা।

বাংলাদেশে ইসকনের বর্তমান কার্যক্রম

ইসকন বাংলাদেশে একটি স্বীকৃত ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে কাজ করে।

সংগঠনটি সনাতনী হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত।

তারা নিয়মিত মন্দির পরিচালনা, ধর্মীয় আচার পালন এবং সেবামূলক কাজ পরিচালনা করে।

ইসকন দাবি করে যে তারা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে।

বাংলাদেশে ইসকনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজন, নিরামিষভোজ প্রচার এবং স্কুল পরিচালনা।

সংগঠনটি নিয়মিত মানবিক সাহায্য কার্যক্রম পরিচালনা করে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ত্রাণ বিতরণ এবং গরিব মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ তাদের নিয়মিত কাজ।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় একটি সমাবেশ আয়োজন করে ইসকন।

তারা সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এবং নির্যাতনের বিচার দাবি করে।

ইসকন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, তাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ এবং মানবকল্যাণমুখী।

তবে ইসকনকে মৌলবাদী এবং বিদেশি প্রভাবিত সংগঠন হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এই অভিযোগ খতিয়ে দেখছে বলে জানানো হয়েছে।

ইসকনের ধর্মীয় মতাদর্শ

ইসকনের আধ্যাত্মিক ভিত্তি হলো সংস্কৃতে রচিত ভগবৎ গীতা এবং ভগবৎ পুরাণ।

সংগঠনটি গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদকে তাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করে।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদ চৈতন্যদেবের সময় থেকে বাংলা অঞ্চলে প্রসার লাভ করে।

ইসকন দাবি করে, তারা এই আধ্যাত্মিক দর্শন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চায়।

তাদের মূলমন্ত্র হলো, “হরে কৃষ্ণ, হরে রাম”।

ইসকনের ভক্তরা রাস্তায় খোল-করতালের সঙ্গে নৃত্য ও কীর্তনের মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় বার্তা প্রচার করে।

তারা নিজেদের মন্দিরে ধর্মীয় আচার পালন ছাড়াও সেমিনার এবং সভার আয়োজন করে।

ইসকনের মতবাদ বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অন্তর্গত।

হিন্দু ধর্মে বৈষ্ণব সম্প্রদায় ছাড়া শৈব, শাক্ত, সৌর এবং গাণপত্য সম্প্রদায়ও রয়েছে।

হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি মেনে চলে।

বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মতবাদ মূলত ভগবানের সাকার এবং নিরাকার রূপের ওপর ভিত্তি করে।

ইসকন বিশ্বাস করে, কৃষ্ণ হলেন সর্বোচ্চ ঈশ্বর এবং তার সেবা করার মাধ্যমেই মুক্তি লাভ সম্ভব।

তবে ইসকনের মতবাদ নিয়ে বিতর্কও রয়েছে।

অনেকে প্রশ্ন তোলেন, ইসকনের ভাবাদর্শ আদৌ হিন্দু ধর্মের অন্তর্ভুক্ত কি না।

ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসকন অবশ্যই হিন্দু ধর্মের অংশ।

তাদের মতে, ইসকনের ভাবাদর্শ বৈষ্ণব মতবাদের আধুনিক রূপ।

তবে ইসকনের মতবাদে কিছু নতুন উপাদান যোগ হয়েছে, যা তাদের আলাদা করে তোলে।

ইসকন ও আন্তর্জাতিক বিতর্ক

ইসকন শুধুমাত্র ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে নয়, আন্তর্জাতিক বিতর্কেও জড়িত একটি নাম।

বিশ্বের অনেক দেশে ইসকনের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সিঙ্গাপুরে ইসকন প্রতিষ্ঠার শুরুর দিক থেকেই নিষিদ্ধ ছিল।

সিঙ্গাপুর সরকারের পক্ষ থেকে তাদের রেজিস্ট্রেশন আটকে দেওয়া হয়েছিল।

পরবর্তীতে অন্য নামে কাজ শুরু করলেও সেখানেও নানা সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে ইসকনের কার্যক্রম প্রকাশ্যে পরিচালনা করা সম্ভব নয়।

সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশে ধর্মীয় কারণে ইসকনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ।

চিনে ইসকনকে গোপনে কাজ চালাতে হয় বলে সংগঠনটির ওয়েবসাইটে উল্লেখ রয়েছে।

তবে পাকিস্তানে ইসকনের অন্তত ১২টি মন্দির রয়েছে।

পাকিস্তানে তারা সক্রিয়ভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে।

রাশিয়ায় ইসকনের কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশ কয়েকবার আইনি লড়াই হয়েছে।

সেখানে সংগঠনটির ধর্মীয় প্রচারণার পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক উঠেছে।

ইসকনের বিরুদ্ধে শিশু নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়ে।

বিভিন্ন দেশে ইসকনের নেতাদের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে।

কিছু নেতার বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগও রয়েছে।

ইসকনের আর্যতত্ত্বে বিশ্বাস এবং বর্ণভেদের ধারণা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে।

তবে সংগঠনটি সব অভিযোগই বরাবরই অস্বীকার করেছে।

বিশ্বব্যাপী বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও, ইসকন তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

বাংলাদেশে ইসকন বিরোধী বিতর্ক

বাংলাদেশে ইসকনকে নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়।

সংগঠনটি ধর্মীয় মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

কিছু মানুষ দাবি করেন, ইসকন উগ্রবাদী ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচার করে।

সম্প্রতি সিলেটে ইসকনের এক সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে।

তার সঙ্গে ইসকনের সম্পৃক্ততা ইস্যুটি আরও বেশি আলোচনায় এনেছে।

বাংলাদেশে ইসকনের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হলো ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এর সম্পর্ক।

ইসকনের নেতারা ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিয়ে বিতর্কিত হয়েছেন।

অনেকে মনে করেন, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করছে।

ইসকনের সঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র আদর্শের মিল রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে কিছু সন্ন্যাসীর বক্তব্য ইসকনের ভারত-সম্পর্ককে জোরদার করেছে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ইস্যুতে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিতে ইসকনের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়।

কিছু বিশ্লেষক বলেন, ইসকনের কার্যক্রম আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে।

সরকারি সূত্র জানিয়েছে, ইসকনের কার্যক্রম নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পর্যবেক্ষণ করছে।

তবে ইসকনের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।

তারা দাবি করে, সংগঠনটি শুধুমাত্র ধর্মীয় এবং মানবকল্যাণমূলক কাজেই নিয়োজিত।

ইসকনের বৈশ্বিক সাফল্য ও বিতর্কের মিশ্র প্রভাব

ইসকন একদিকে ধর্মীয় জগতের প্রভাবশালী একটি সংগঠন।

সংগঠনটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে লাখ লাখ ভক্ত তৈরি করেছে।

বিটলস ব্যান্ডের জর্জ হ্যারিসন ছিলেন ইসকনের বিখ্যাত সমর্থকদের একজন।

তিনি সংগঠনের জন্য প্রচুর দান করেছেন এবং ‘মাই সুইট লর্ড’ গানটি তাদের অনুপ্রাণিত হয়ে রচনা করেন।

অ্যালেন গিন্সবার্গ এবং স্টিভ জবসও ইসকনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

ফোর্ড মোটর কোম্পানির উত্তরাধিকারী অ্যালফ্রেড ফোর্ড ইসকনের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন।

এই বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা ইসকনের বৈশ্বিক প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

তবে ইসকনের বিতর্কিত দিকগুলোও তার সাফল্যের পাশাপাশি বিদ্যমান।

বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনাগুলো সংগঠনের ভাবমূর্তিতে আঘাত করেছে।

অভিযোগগুলো সত্য হোক বা মিথ্যা, সংগঠনের কার্যক্রম নিয়ে জনমনে সংশয় তৈরি হয়েছে।

ইসকন একদিকে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিতর্কের অংশ।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসকনের কার্যক্রমের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

সাফল্য এবং বিতর্কের মধ্য দিয়ে ইসকন তার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

এটি একটি সংগঠন, যা একইসঙ্গে ধর্মীয় প্রচারণা এবং বৈশ্বিক বিতর্কের অংশীদার।

আরও পড়তে পারেন