,

বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ কারণেই মূল্যস্ফীতির জেঁকে বসা, দীর্ঘস্থায়ী সংকট

দুই বছরের বেশি সময় ধরে নিত্যপণ্যের দামে উর্ধ্বমুখিতা, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ঊর্ধ্বমুখী। এর ফলে ক্রমাগত দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয়কে সংকুচিত করছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে, জীবনযাত্রার মানও পড়েছে হুমকির মুখে। এমনকি এই দীর্ঘায়িত মূল্যস্ফীতি পূর্বে কখনোই নিত্যপণ্যের বাজারে এতো দীর্ঘ সময় ধরে বিরাজ করতে দেখা যায়নি।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকে শুরু হওয়া এই মূল্যস্ফীতির জন্য বহিঃস্থ কারণগুলোকে দায়ী করা হয়েছিল। বিশেষত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট, ডলারের বিনিময় হারে অসামঞ্জস্যতা এবং আমদানি করা পণ্যের দামের বৃদ্ধি সবমিলিয়ে অর্থনৈতিক অবস্থা সংকটাপন্ন করে তুলেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, অভ্যন্তরীণ কারণগুলোই মূলত দেশে এই মূল্যস্ফীতির পেছনে ভূমিকা রাখছে।

অভ্যন্তরীণ কারণের প্রাধান্য

বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি প্রকাশিত তাদের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে জানায়, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশের হেডলাইন মূল্যস্ফীতির অর্ধেকের বেশি এসেছে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি থেকে। বিশেষত, খাদ্যশস্য ও সবজির দাম বৃদ্ধি এই অবস্থার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। এর আগে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে আমিষ পণ্য, মসলা এবং রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাজারে সংকট দেখা দেয়। চাল, গম এবং সবজির দামও ছিল উর্ধ্বমুখী, যা নিত্যপণ্যের বাজারকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। তারা মনে করেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে কিছু অভিযানের উপর নির্ভরশীল থাকলেও তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন তারা।

মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১৫ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও, সাম্প্রতিক প্রান্তিকে এর প্রভাব কিছুটা কম দেখা গেছে। তবে হেডলাইন মূল্যস্ফীতিতে বাড়িভাড়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিগত সেবা খাতে ব্যয় বাড়া পরিস্থিতিকে আরও ঘনীভূত করেছে। পচনশীল পণ্য এবং সেবা খাতে মূল্যবৃদ্ধির কারণেও সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকার বাজেটের আকার সংকোচন এবং সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের পথে হাঁটলেও বাজার ব্যবস্থাপনায় পূর্বের কৌশলই বজায় রাখছে। এতে বাজারের চাঁদাবাজির মতো অবৈধ কার্যকলাপ বেড়েছে এবং বাজারে প্রতিযোগিতা কমেছে, যা সিন্ডিকেটদের শক্তিশালী করেছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।

অভ্যন্তরীণ কারণে সংকট

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের মূল্যস্ফীতিতে আমদানিনির্ভর পণ্যের অবদান কমে ২৬ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ পণ্যের অবদান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ শতাংশে। সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার কিছুটা স্থিতিশীল হলেও অভ্যন্তরীণ কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে।

এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বন্যা, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, এবং চাহিদা-সরবরাহের পার্থক্যকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া সরকারের মজুদ দিয়ে বাজারকে প্রভাবিত করার সক্ষমতা কমে আসায় পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।

বাজারে অব্যবস্থাপনা

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি নির্ধারকরা যে ভুল করেছেন, তার প্রভাব এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন যে, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি বিশ্বব্যাপী সংকট হলেও, বাংলাদেশে এর নিয়ন্ত্রণে অভ্যন্তরীণ নীতি-ভুলগুলো গুরুত্ব পেয়েছে।

তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, বাজারে অব্যবস্থাপনা এবং সিন্ডিকেট প্রভাবের কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। বাজারে পণ্যের যথাযথ সরবরাহ, নতুন বিক্রেতাদের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ সৃষ্টি এবং চাঁদাবাজি বন্ধ করার মতো বিষয়গুলোতে নজর দিতে হবে।

টানা মূল্যস্ফীতি এবং ভবিষ্যৎ সংকট

২০২২-২৩ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের ওপরে। এরপর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে পৌঁছায়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেও একই ধরনের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাজারের এই অস্থিতিশীলতা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে দেশের নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের মানুষদের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।

আরও পড়তে পারেন