বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত ৫ই অগাস্টের পর থেকে একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, যা নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের ইঙ্গিত দেয়। আওয়ামী লীগবিহীন এই রাজনৈতিক মাঠে সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশে পরিবর্তন আসবে তা অনেকটাই নিশ্চিত। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান দুই শক্তি হলো বিএনপি এবং তাদের পূর্বেকার রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামী। তবে নতুন একটি শক্তি হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব ফেলছে, যদিও তারা কোনও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল নয়।
নতুন সমীকরণে জামায়াত ও ছাত্র আন্দোলন
আওয়ামী লীগবিহীন এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন সমীকরণে প্রধান দুটি শক্তি হিসেবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর উপস্থিতি দৃশ্যমান হলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকেও উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। বিশেষত এই আন্দোলন রাজনৈতিক দল না হলেও, তাদের কার্যক্রম ও আদর্শ রাজনীতির মাঠে অন্যদের চেয়ে কম প্রভাব রাখছে না।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফসল এবং তাদের পছন্দমতো গঠিত। তবে এই অবস্থানে এসে বিএনপির সাথে কিছু মতানৈক্য স্পষ্ট হচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইতোমধ্যেই তাদের বক্তব্যে কিছু ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন, যেখানে জামায়াত ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কিছু মতামতের সাথে বিএনপির সামঞ্জস্য নেই।
প্রথমত, নির্বাচন নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ পাচ্ছে। বিএনপি মনে করে দ্রুত নির্বাচন হওয়া উচিত, যেখানে জামায়াতে ইসলামীর কোনও তাড়া নেই। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে বিএনপির সতর্কতা রয়েছে। যদিও ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন, তাদের নতুন দল গঠনের কোনও পরিকল্পনা আপাতত নেই, তবে বিএনপি সতর্ক দৃষ্টি রাখছে এই প্রসঙ্গে।
বিএনপি কি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শত্রু-মিত্র সম্পর্ক নতুন কোনও বিষয় নয়। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একসময়ের রাজনৈতিক মিত্ররাই পরবর্তীতে একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৫ সালে সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান মুক্ত হন এবং ক্ষমতায় আসার পথ সুগম হয়। সে সময় জাসদ নেতা আবু তাহের ও জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ছিলেন জিয়াউর রহমানের মিত্র। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জাসদ আওয়ামী লীগের মিত্র ও বিএনপির শত্রুতে পরিণত হয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জামায়াতে ইসলামী কি বিএনপির জন্য বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে? বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান মনে করেন, ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনের অন্তর্নিহিত স্পিরিট উপলব্ধি করলে বোঝা যাবে এখানে কোনও দ্বন্দ্ব বা মতবিরোধের সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এই আন্দোলনে ছাত্র-জনতা মিশে গিয়েছিল, এবং সাধারণ ছাত্র হিসেবে তারা আন্দোলন করেছে।
তবে নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মতভেদ স্পষ্ট। বিএনপি নির্বাচনের জন্য একটি রোডম্যাপ চায়, যেখানে জামায়াত এ বিষয়ে নিরব। জামায়াত বিলম্ব করতে চায় কারণ তারা জানে এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে তারা যথেষ্ট ভোট পাবে না। যদিও বিএনপি এই মতানৈক্যকে কোনও বড় সংকট হিসেবে দেখছে না।
নতুন দল গঠনের ভাবনা এবং রাজনৈতিক প্রভাব
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলছে, তারা এখনও কোনও রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা করছে না। তারা আপাতত একটি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করছে এবং রাষ্ট্রের সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করছে। তবে বিএনপির দৃষ্টিতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে যদি কোনও রাজনৈতিক দল গঠিত হয়, সেটা হতে পারে নতুন একটি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
বিএনপি বলছে, যদি ছাত্ররা দল গঠন করে তবে সেটি তাদের মৌলিক অধিকার। তবে এ মুহূর্তে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে কোনও সরাসরি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তারা দেখছে না। ছাত্রদের কোনোরকম রাজনৈতিক উদ্যোগ থাকলেও সেটি এখনও নিশ্চিত নয়। তবে ভবিষ্যতে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা নির্ভর করবে জনগণের মতাদর্শ ও ভোটের উপর।
জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির নতুন সমীকরণ
জামায়াতে ইসলামী বিএনপির অন্যতম মিত্র হলেও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে কিছু মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই ভিন্নমত। জামায়াতে ইসলামী এখন দ্রুত নির্বাচন নিয়ে কোন চিন্তা করছে না, বরং তারা নিজেদের গুছিয়ে আনতে আরও সময় চাচ্ছে। তাদের লক্ষ্য হল, ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির মাধ্যমে নির্বাচনে ভালো ফলাফল করা।
এদিকে, বিএনপি জামায়াতে ইসলামীকে এখনও বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছে না। জামায়াতের প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, নতুন কোন রাজনৈতিক দল আসতে চাইলে সেটি তাদের সাংবিধানিক অধিকার এবং জামায়াত সেটিকে স্বাগত জানাবে। তবে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে নতুন কোন মোর্চা গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা থাকলেও এখন পর্যন্ত সে বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
রাজনীতির ভবিষ্যৎ ধারা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামনের দিনগুলোতে নির্বাচন এবং নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিশেষত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির কৌশল আগামী নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলবে।
বিএনপি বলছে, জনগণ যাকে ভোট দেবে, সেই সরকার গঠন করবে। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আরিফ সোহেল বলছেন, ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে আলোচনা হতে পারে, তবে সেটি এখনও নিশ্চিত নয়। তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সময় এলে ছাত্র আন্দোলন নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে মঞ্চে আসতে পারে, এবং সেটি নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্পর্ক পরিবর্তন হতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। তাই ভবিষ্যতের রাজনীতিতে বিএনপি, জামায়াত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং অন্যান্য নতুন উদীয়মান শক্তিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে, সেটাই দেখার বিষয়।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা