বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনটি বড় গণঅভ্যুত্থান দেশটির রাজনৈতিক দিক পরিবর্তন করেছে, যার প্রতিটি ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে বিএনপি। ১৯৭৫, ১৯৯০ এবং ২০২৪ সালের এই অভ্যুত্থানগুলো রাজনৈতিক মঞ্চে বিএনপিকে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক হয়েছে। এই ঘটনাগুলোর পর বিএনপি হয় ক্ষমতায় এসেছে, নয়তো ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাঈদ ইফতেখার মনে করেন, দুটি বড় গণঅভ্যুত্থানের পরে রাজনৈতিক শূন্যতার সুবিধা পেয়েছে বিএনপি। প্রতিটি ঘটনাতেই, আওয়ামী লীগ এক নেতিবাচক শক্তি হিসেবে জনগণের কাছে প্রতিভাত হয়েছে, আর সেই সুযোগে বিএনপি রাজনৈতিক মাঠের ফায়দা তুলতে পেরেছে।
সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান ১৯৭৫: রাজনৈতিক শূন্যতায় বিএনপির উত্থান
১৯৭৫ সালের সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ওই বছরের ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি গভীর রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে পড়ে। একদলীয় শাসনব্যবস্থা তথা বাকশাল প্রবর্তনের মাধ্যমে মুজিববিরোধী মনোভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, এবং শেষপর্যন্ত সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। তবে তখনো রাজনৈতিকভাবে দৃঢ় কোনো বিকল্প দল বা শক্তি মঞ্চে ছিল না।
তৎকালীন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, যিনি মুজিব হত্যার পর ক্ষমতা দখল করেন, ছিলেন আওয়ামী লীগেরই একজন নেতা। কিন্তু সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান, যিনি সেনানিবাসের বাইরেও জনপ্রিয় ছিলেন, সেই সময় ধীরে ধীরে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়। এই অভ্যুত্থানটি ছিল ভারতবিরোধী একটি আন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ। কর্নেল আবু তাহের এবং তার জাসদ-সমর্থিত সৈনিকদের নেতৃত্বে ঢাকার রাস্তায় লাখ লাখ জনতা নেমে আসে।
মওদুদ আহমদ তার বই ‘চলমান ইতিহাস’-এ উল্লেখ করেছেন, “সেদিন সিপাহী-জনতার মিছিল এবং বিক্ষোভ ভারতের এবং আওয়ামী লীগের বিরোধিতার প্রকাশ হিসেবে দেখা হয়েছিল।” এই অভ্যুত্থানের ফলে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় উঠে আসেন, এবং ১৯৭৭ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপরই তিনি বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) প্রতিষ্ঠা করেন, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এরশাদের পতন: বিএনপির দ্বিতীয় সাফল্যের অধ্যায়
১৯৮০-এর দশকে, বাংলাদেশের সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের শাসনামলে দেশজুড়ে ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু হয়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়েই এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়। তবে ১৯৮৬ সালে একটি অপ্রত্যাশিত মোড় আসে, যখন আওয়ামী লীগ এরশাদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। অনেকেই মনে করেন, এটি আওয়ামী লীগের একটি কৌশলগত ভুল ছিল, যা তাদের জনসমর্থন ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
মওদুদ আহমদের লেখা অনুযায়ী, “সরকারের সাথে এক গভীর সমঝোতার পর আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এরশাদের অধীনে নির্বাচন অংশ নেওয়ায় জনমনে তাদের প্রতি একটি নেতিবাচক ধারণা জন্মায়।” রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাঈদ ইফতেখার বলছেন, বিএনপি তখন জনগণের কাছে একটি ধারণা তৈরিতে সফল হয় যে, আওয়ামী লীগ যদি ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ না নিত, তবে এরশাদের পতন আগেই হতে পারত। এর ফলে, ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর অনুষ্ঠিত ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে।
২০২৪ সালের অভ্যুত্থান: আবারও বিএনপির সুযোগ
২০২৪ সালে আবারো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করে দেয় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। ৫ই আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাধ্য হন ক্ষমতা ত্যাগ করতে এবং ভারত পালিয়ে যেতে। আওয়ামী লীগের প্রায় ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এই অভ্যুত্থানের পর, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে সক্ষম হয়েছে।
শেখ হাসিনার পতনের পরপরই রাষ্ট্রপতি খালেদা জিয়ার মুক্তির আদেশ দেন, এবং বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা জেল থেকে মুক্তি পেতে শুরু করেন। লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির নেতা তারেক রহমানের বক্তব্যও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে, যা পূর্বে নিষিদ্ধ ছিল। মাঠ পর্যায়ের বিএনপি কর্মীরাও পুনরায় সক্রিয় হতে শুরু করে। এসব ঘটনা বিএনপির জন্য তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক সুবিধা এনে দেয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে প্রতিভাত হয়েছে। অনেকেই বিএনপির ‘ফ্যাসিবাদ’ তকমা তখন আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা শুরু করেছে। সাঈদ ইফতেখার বলেন, “যেভাবে ১৯৭৫ এবং ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতিবাচক হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে, সেই সুযোগটা স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি পেয়েছে।”
বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের তুলনা: ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বারবার দেখা গেছে যে, যখনই আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়েছে, বিএনপি সেই শূন্যতা পূরণ করেছে। তবে এই দুটি প্রধান দলের মধ্যে বাস্তবিকপক্ষে তেমন কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই বলে বিশ্লেষকদের মত। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ—উভয়েই বাংলাদেশের পুরোনো রাজনৈতিক ঐতিহ্যের অংশ, তাদের মধ্যে অমিল থাকলেও মিলও প্রচুর।”
তবে ভবিষ্যতে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে এমন নতুন রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব হলে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ ভিন্ন দিকে যেতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে, বিএনপি রাজনৈতিক সুবিধা পেলেও ভবিষ্যতের রাজনীতিতে তারা কতটা সফল হবে তা নির্ভর করবে জনগণের চাহিদা ও অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভবের ওপর।