,

বাংলাদেশের বাজারে অস্থিরতা ও ভারতীয় রফতানি হ্রাস: দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বড় ধাক্কা

ভারত থেকে বাংলাদেশে রফতানির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ায় বাজারে বাড়ছে পণ্যের দাম, দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের অনিশ্চয়তা বাড়ছে

বাংলাদেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির পেছনে ভারতের রফতানি হ্রাস একটি বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে। গত অগাস্ট মাসে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার পর থেকে অনেকেই ধারণা করছেন, ভারত থেকে পণ্য রফতানির পরিমাণ আচমকা কমে যাওয়াই এই অস্থিরতার মূল কারণ।

অগাস্ট মাসে ভারত থেকে বাংলাদেশের রফতানি প্রায় ২৮ শতাংশ কমে গিয়েছিল, যদিও সেপ্টেম্বরে কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। কিন্তু অক্টোবর মাসে বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দর দিনের পর দিন বন্ধ থাকায় বাণিজ্যে আবারও প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অগাস্ট মাসে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের রফতানি ৬৮১ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যেখানে ২০২৩ সালের অগাস্টে ছিল ৯৪৪ মিলিয়ন ডলার। ফলে গত বছরের তুলনায় ২৭.৮৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে রফতানি। বিশেষজ্ঞদের মতে, অগাস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই ধস নেমেছিল।

বাংলাদেশের বাজারে মূল্যস্ফীতি ও সংকট

বাংলাদেশের বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ইতোমধ্যেই ক্রেতাদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাল, পেঁয়াজ, ভোজ্য তেল এবং চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। বিশেষ করে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে অত্যধিকভাবে। যদিও সেপ্টেম্বরে ভারত পেঁয়াজ রফতানির ওপর বিধিনিষেধ শিথিল করেছিল, বাংলাদেশের বাজারে তা সত্ত্বেও প্রভাব ফেলতে পারেনি।

ভারত থেকে রফতানির ওপর বিধিনিষেধ উঠিয়ে নেওয়া হলেও, পেট্রাপোল-বাংলাদেশ সীমান্তে স্থলবন্দর বন্ধ থাকার কারণে পণ্যের সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে। চলতি মাসে দুর্গাপূজা ও অন্যান্য ছুটির কারণে পেট্রাপোল বন্দর পাঁচ দিন বন্ধ ছিল। এরপর আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর অনুষ্ঠানের জন্য চারদিন বন্ধ থাকে বন্দর।

দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সংকট

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘সেপা’ নামে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট নিয়ে আলোচনা চলছে বহু বছর ধরে। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং বাণিজ্যিক অস্থিরতার কারণে এই চুক্তির ভবিষ্যৎ এখন বেশ অনিশ্চিত। বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় ভারতের বিভিন্ন শিল্পকেও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

ভারতের রেটিং এজেন্সি ‘ক্রিসিল’ তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ভারতের রফতানিমুখী শিল্পগুলোতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং সামগ্রী এবং কৃষিপণ্যর ক্ষেত্রে প্রভাব দেখা যেতে পারে।

কৃষি ও অন্যান্য পণ্যের রফতানি কমছে

ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রতি রফতানি হওয়া বেশিরভাগ পণ্যের পরিমাণই কমেছে। যেমন, ডাল, বাদাম, শুকনো ফল, সিরিয়াল এবং কোকো প্রিপারেশনের রফতানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। শুধু তাই নয়, কৃষিকাজের জন্য অপরিহার্য রাসায়নিক সারের আমদানিও প্রায় ৯৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা বাংলাদেশের কৃষিখাতে প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে, ফার্মাসিউটিক্যাল প্রোডাক্টস বা ওষুধ এবং তুলার মতো কিছু পণ্যের রফতানি বেড়েছে। এছাড়া তামাকজাত দ্রব্যের রফতানিতে রেকর্ড ৩৯২ শতাংশ বৃদ্ধিও দেখা গেছে। তবে এসব পণ্য ছিল ব্যতিক্রম।

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংকট ও ভারতের উদ্বেগ

বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষ করে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা, মূল্যস্ফীতি এবং ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমেছে। এতে ভারতের বাজারেও প্রভাব পড়ছে। ভারতের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে তা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও দুর্বল করে তুলতে পারে।

ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের একটি বড় অংশই আসে পেট্রাপোল স্থলবন্দর দিয়ে। তবে, পেট্রাপোল ও বেনাপোল স্থলবন্দর প্রায়ই নানা কারণে বন্ধ থাকে, যার ফলে বাণিজ্যে অচলাবস্থা তৈরি হয়। বন্দর বন্ধ থাকলে বাংলাদেশের বাজারে পণ্যের সরবরাহে সংকট দেখা দেয়, এবং এর ফলস্বরূপ পণ্যের দাম বাড়ে।

মহারাষ্ট্র নির্বাচন ও পেঁয়াজের সংকট

ভারতীয় রাজনীতির প্রভাবও বাংলাদেশে পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে। মহারাষ্ট্রের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের কারণে পেঁয়াজ রফতানির বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর এই পরিস্থিতি আবার বদলে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

ভারতের খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম ইতোমধ্যে বেড়েছে, ফলে আগামী দিনে ভারত সরকার নতুন করে পেঁয়াজ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। এর প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশের বাজারে পড়বে এবং পেঁয়াজের দাম আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অর্থনৈতিক পর্যালোচনা ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

ভারতের প্রথম সারির অর্থনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘আইডিয়াজ ফর ইন্ডিয়া’ মনে করছে, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ভারতীয় রফতানি শিল্পে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে চরম বেকারত্ব এবং মূল্যস্ফীতি বাণিজ্যের চাহিদা কমিয়ে দিচ্ছে।

তারা বলছেন, ২০১০-১১ সালেও যেখানে বাংলাদেশে ভারতের বার্ষিক রফতানি ছিল ৩.২ বিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ অর্থ বছরে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬.২ বিলিয়ন ডলারে। তবে গত দুই বছরে সেই অঙ্ক আবার কমতে শুরু করেছে।

অন্যদিকে, ভারতের রেটিং এজেন্সি ‘ক্রিসিল’ও মনে করছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি দীর্ঘদিন চলতে থাকে, তবে ভারতের রফতানিমুখী শিল্পগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে, গার্মেন্টস শিল্প, জুতো, সফট লাগেজ, এফএমসিজি ইত্যাদি খাতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে, পাট শিল্প ও জাহাজ ভাঙার শিল্প বাংলাদেশ পরিস্থিতি থেকে কিছুটা লাভবান হতে পারে।

ভারতে বাণিজ্যের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

‘ক্রিসিল’ এর রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদল ভারতের রফতানি নির্ভর শিল্পগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে বেশ কিছু প্রতিকূলতার মুখে ফেলতে পারে। বিশেষত যেসব শিল্পগুলি সরাসরি বাংলাদেশের বাজারের ওপর নির্ভরশীল, যেমন তৈরি পোশাক, চামড়া, ইলেকট্রনিক পণ্য এবং নির্মাণ সামগ্রী, তাদের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভারতের অনেক রফতানি প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হতে পারে। বিশেষত ছোট এবং মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য এই পরিস্থিতি মারাত্মকভাবে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ তারা বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলির মতো ব্যাকআপ ব্যবস্থা বা বিশাল বিনিয়োগ না থাকার কারণে দ্রুত আর্থিক সমস্যায় পড়তে পারে।

বাংলাদেশের বাজারে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস

বাংলাদেশের চলমান মূল্যস্ফীতি এবং ক্রমবর্ধমান ডলার সংকটের কারণে স্থানীয় বাজারে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশে আমদানির চাহিদা এখনই উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে, যার প্রভাব ভারতীয় রফতানির উপরও পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের বাজারে এখন মূলত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর উপরই বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় বা বিলাসী পণ্যগুলোর চাহিদা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ফলে এ ধরনের পণ্য রফতানির জন্য যেসব ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশকে অন্যতম প্রধান গন্তব্য হিসেবে দেখেছিল, তারা এখন ক্রমশ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে।

বেনাপোল-পেট্রাপোল বন্দরের অস্থিরতা

ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যকার অন্যতম প্রধান বাণিজ্য পথ বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দর দীর্ঘদিন ধরেই অস্থিরতার শিকার। ভারতের পেট্রাপোল চেকপোস্টে নানা কারণে পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা রফতানি বাণিজ্যের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে।

গত মাসেই পাঁচ দিন ধরে দুর্গাপূজার ছুটির জন্য বন্দর বন্ধ ছিল। এরপর মন্ত্রীর সফরের কারণে আরও চার দিন বন্দর বন্ধ রাখা হয়েছিল। এরকম পরিস্থিতিতে দুই দেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির মুখে পড়ছে। পচনশীল পণ্যগুলো বন্দরে আটকে থাকায় ব্যবসায়ীদের বিশাল লোকসান গুণতে হচ্ছে।

ভবিষ্যতে ভারত-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি

বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে একটি ‘মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি’ বা সেপা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছিল। তবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই চুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যতদিন না পর্যন্ত দুই দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসে, ততদিন এই ধরনের বাণিজ্য চুক্তির বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। ফলে দীর্ঘমেয়াদে দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর এর বড় প্রভাব পড়তে পারে।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও অন্যান্য পরিষেবা খাতে প্রভাব

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতেও ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অংশীদারিত্ব রয়েছে। ভারতের বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই অর্থ পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ভারতীয় বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো তাদের প্রাপ্য অর্থ সময়মতো পাচ্ছে না। এর ফলে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং তাদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সংকটে পড়ছে।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের প্রস্তুতি

ভারতের ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হলে বাংলাদেশ এবং ভারতের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। ভারতের অনেক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে তাদের ব্যবসায়িক কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের বাজারে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা কমে গেছে। তবে একইসঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কিছু পশ্চিমা দেশের অর্ডার ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পেতে পারে। বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে এ ধরনের কিছু সুযোগ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আরও পড়তে পারেন