অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল—মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন এবং ব্যাংকিং খাতের বিপর্যস্ত অবস্থা। গার্হস্থ্য উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য রক্ষা করা এবং বাজার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা ছিল অন্যতম অগ্রাধিকার। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখা গেলেও, বেশ কয়েকটি বিষয়ে সংকট এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মূল্যস্ফীতির চাপে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রা যেখানে ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে, সেখানে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা আরও তীব্র হয়েছে।
রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স: কিছুটা স্বস্তি
বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে। ২০২১ সালের আগস্টে যেখানে রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, সেটি ক্রমশ কমতে থাকে। আমদানি ব্যয়ের চাপ এবং অর্থ পাচারের মতো চ্যালেঞ্জগুলোকে এ সংকটের প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে বেশ কয়েকটি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে, প্রবাসী আয়ের ওপর দেওয়া বিনিময় হারের সঙ্গতি আনয়ন করা হয়েছে। এর ফলে, প্রবাসীদের ফরমাল চ্যানেলে টাকা পাঠানোর পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে রেমিট্যান্স ছিল ১৯১ কোটি ডলার, যা আগস্টে ২২২ কোটি ডলার এবং সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ডলারে পৌঁছায়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে রিজার্ভ সংকটের চাপ অনেকটাই কমে আসবে। তবে, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হলে টাকার মান আরও কমতে পারে।
অক্টোবরে আইএমএফ-এর নির্ধারিত পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভ দাঁড়ায় ১৯৮৪ কোটি ডলার, যা তুলনামূলকভাবে কম। তবে, এই সময়ের মধ্যে বেশ কিছু ঋণ ও বকেয়া পরিশোধ করেও রিজার্ভে সরাসরি চাপ পড়েনি। অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের মতে, বৈদেশিক মুদ্রার বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের উদ্যোগে ইতিবাচক ফল দেখা যাচ্ছে।
ব্যাংক খাতে পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত। তারল্য সংকট, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং অনাদায়ী ঋণের বোঝা ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়। তবে তারল্য সংকটের কারণে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এই সীমা তুলে নেওয়া হলেও কিছু ব্যাংক এখনো গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা সরবরাহ করতে পারছে না।
দুর্বল ব্যাংকগুলোকে চাঙ্গা করতে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এই অর্থ সবল ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া হলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি দীর্ঘমেয়াদে কোনো কার্যকর সমাধান নয়। অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে. মুজেরীর মতে, “এইভাবে ঋণ দিয়ে সাময়িক সমাধান করা সম্ভব, কিন্তু মূল সমস্যাগুলো সমাধান হচ্ছে না।”
ব্যাংক খাতে সংস্কারের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। অডিটের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনা করার কথা থাকলেও এই প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠনে শ্বেতপত্রের সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি।
মূল্যস্ফীতি: মানুষের কষ্টের কারণ
মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনে গভীর সংকট তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে এই হার আরও বেশি—১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি এবং আমদানির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ শিথিল করার পরেও পরিস্থিতি খুব একটা উন্নত হয়নি।
বাজার তদারকির নামে খুচরা বিক্রেতাদের ওপর জরিমানা করা হচ্ছে, যা ভোক্তার ওপরই চাপ সৃষ্টি করছে। অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “বাজারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে বড় পাইকারি বাজারগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও তথ্য প্রকাশ করা প্রয়োজন।”
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদও স্বীকার করেছেন যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। “চাঁদাবাজি এবং বাজার ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগবে,” তিনি বলেন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে সংকট আরও বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাজার নিয়ন্ত্রণ: কাঠামোগত সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজার ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি এবং বাজার ব্যবস্থার ত্রুটি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় আসার পর বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে আমদানিতে শুল্ক ছাড়, পেঁয়াজ-ডিমের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ বাড়ানো, এবং বাজার তদারকির মাধ্যমে খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা উল্লেখযোগ্য। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, এই উদ্যোগগুলোর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের সম্ভাবনা নেই।
বাজার তদারকির নামে জরিমানার পরিণতি কী হতে পারে, সে বিষয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, “খুচরা বিক্রেতাদের জরিমানা করলে তারা সেই বাড়তি খরচ ভোক্তার কাছ থেকেই তুলবে। এতে বাজারে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।”
বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে পাইকারি পর্যায়ের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং আমদানি ও সরবরাহের তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। “যদি বাজারে স্বচ্ছতা তৈরি করা যায়, তাহলে স্বাভাবিকভাবে দাম কমবে,” বলেন তিনি।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদও স্বীকার করেছেন যে বাজার ব্যবস্থার কাঠামোগত ত্রুটি ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, “এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন।”
ব্যাংকখাত সংস্কার: টাস্কফোর্স ও শ্বেতপত্রের দিকনির্দেশনা
বাংলাদেশের আর্থিক খাতের দুর্নীতি ও দুর্বলতা বহুদিন ধরে আলোচনায়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংক খাতের সংকট নিরসনে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
১১টি দুর্বল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন এবং সাতটি ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই উদ্যোগগুলো মূল সমস্যার সমাধান নয়। “এই পদক্ষেপগুলো সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য কার্যকর পুনর্গঠন প্রয়োজন,” বলেন অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে. মুজেরী।
অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। একই সঙ্গে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটিও ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা ও খেলাপি ঋণ সমস্যার উৎস চিহ্নিত করার কাজ করছে। ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে দুর্বল ব্যাংকগুলোর অডিট শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, “দুর্বল ব্যাংকগুলোতে অডিট শুরু হলে সমস্যার গভীরতা জানা যাবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।” তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অডিট প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে এবং নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করতে হবে।
ব্যাংকখাত পুনর্গঠনের জন্য সরকারের সমন্বিত ও সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন অর্থনীতিবিদরা।
মূল্যস্ফীতির প্রভাব: সাধারণ মানুষের সংকট
মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি নিম্ন আয়ের মানুষের উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে।
অক্টোবরে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে পৌঁছায়, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে। সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে এবং আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়েছে। তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগগুলোর সুফল আসতে সময় লাগবে। মুদ্রানীতির প্রভাব দেখতে অন্তত এক বছর অপেক্ষা করতে হবে।”
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং পণ্যের সরবরাহ চেইনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ছাড়া মূল্যস্ফীতি কমানো কঠিন হবে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে আমদানি এবং স্থানীয় উৎপাদনের মধ্যে ভারসাম্য আনা প্রয়োজন।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। শুধুমাত্র স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।”
সরকার যদি কাঠামোগত সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।