Bangabandhu Satellite
, ,

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মুনাফা নিয়ে বিতর্ক: লোকসানের চেয়ে বেশি কি লাভ?

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১, যা ২০১৮ সালে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল, বর্তমানে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করছে বলে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। স্যাটেলাইটটির পরিচালনাকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) একটি লাভজনক কোম্পানি হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করলেও, প্রকৃতপক্ষে তারা লোকসানের মধ্যে রয়েছে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

মুনাফা বনাম লোকসান: নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য

প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিএসসিএল ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৫ কোটি টাকার মুনাফা দেখিয়েছে। তবে, স্যাটেলাইটের অবচয় বা ডেপ্রিসিয়েশন হিসাব করা হয়নি। যদি ১৮৬ কোটি টাকার অবচয় হিসাব ধরা হয়, তবে সেই অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃতপক্ষে প্রায় ৬৬ কোটি টাকা লোকসানে রয়েছে। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতার কারণে নিরীক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান এস এফ আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানি তাদের প্রতিবেদনে অবচয় না দেখানোর ব্যাপারে ডিসক্লোজার দিয়েছে। তিনজন সনদধারী হিসাববিদও এ ব্যাপারে একমত প্রকাশ করেছেন যে, অবচয় গণনা না করায় প্রকৃত আর্থিক চিত্র উঠে আসছে না।

স্যাটেলাইটের পরিচালনার চ্যালেঞ্জ

বিএসসিএলের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে স্যাটেলাইটের সম্পদ মূল্য সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এর একটি কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে যে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) তাদের সম্পদ বিবরণী থেকে স্যাটেলাইটের সম্পদমূল্য হস্তান্তর করেনি। তবে বিটিআরসির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ১৮৬ কোটি টাকার অবচয় দেখানো হয়েছে, যা স্যাটেলাইট পরিচালনার প্রকৃত খরচকে প্রতিফলিত করে। বিটিআরসির আয়ের সাথে এই অবচয় বিবেচনায় স্যাটেলাইটের খরচ বড় ধরনের প্রভাব ফেলেনি, তবে বিএসসিএলের ক্ষেত্রে এটি বিশাল প্রভাব ফেলেছে।

কেন লোকসান হচ্ছে?

বিএসসিএল ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩০ কোটি টাকার আয় করেছে, যা মূলত বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং কিছু বিদেশি চ্যানেলের কাছে ব্যান্ডউইথ বিক্রির মাধ্যমে আসে। তবুও, আয় তুলনামূলকভাবে খরচের থেকে অনেক কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, অবচয় হিসাব না দেখানোয় প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক হিসেবে গণ্য হচ্ছে, যদিও অবচয় ধরা হলে প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে রয়েছে।

স্যাটেলাইট প্রকল্পের নকশার কারণে এর ব্যান্ডউইথ বিক্রিতে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বিএসসিএল। “কে ইউ” ব্যান্ডের ট্রান্সপন্ডারগুলো বিভিন্ন ব্লকে বিভক্ত হওয়ার কারণে, এক ব্লকের একটি ট্রান্সপন্ডার বিক্রি করা গেলে বাকি ট্রান্সপন্ডারগুলো একই দেশে ব্যবহার করতে হয়। এতে অনেক সময় ট্রান্সপন্ডার অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে, ফলে আয় কমে আসছে।

স্যাটেলাইটের বর্তমান অবস্থা

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে দেশের জন্য ২০টি এবং বিদেশের জন্য ২০টি বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু দেশের বাইরের জন্য বরাদ্দকৃত ট্রান্সপন্ডারগুলোর খুব কম ব্যবহার হচ্ছে। ফলে স্যাটেলাইটটির মোট ব্যান্ডউইথের মাত্র ৬০ শতাংশ বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে।

বিএসসিএল বলছে, বর্তমানে প্রায় ৪০টি টেলিভিশন চ্যানেল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করছে। এর মধ্যে ভারতীয় কিছু জনপ্রিয় চ্যানেল যেমন স্টার, সনি, জি নেটওয়ার্ক, এবং কালারস টিভিও রয়েছে। তবুও, বিদেশের বাজারে স্যাটেলাইটটির বিক্রয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

ব্যবসায়িক পরিকল্পনার অভাব

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সঠিক ব্যবসায়িক পরিকল্পনার অভাবে স্যাটেলাইটটি থেকে প্রত্যাশিত আয় আসছে না। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ খলিলুর রহমান বলেছেন, “সঠিকভাবে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা না করার কারণে স্যাটেলাইটটির বিকাশ ঘটেনি এবং এর ব্যাবহারও সীমাবদ্ধ হয়েছে।”

তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানকে (স্পারসো) বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কোনো পর্যায়েই যুক্ত করা হয়নি। ফলে ভবিষ্যতে স্যাটেলাইটের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে দেশীয় প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে।

ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা

যদিও লোকসানের শঙ্কা রয়েছে, বিএসসিএল দাবি করছে যে, তারা ভবিষ্যতে লোকসানের পরিমাণ কমাতে পারবে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে বাজার ধরা এবং আয় বাড়ানোর জন্য আরও আক্রমণাত্মক ব্যবসায়িক কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন।

বর্তমানে, দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনাও সরকারের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্বিতীয় স্যাটেলাইট চালু করার আগে প্রথম স্যাটেলাইটের ব্যবসায়িক মডেলকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

উপসংহার

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মুনাফা ও লোকসান নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত আর্থিক অবস্থা বোঝার জন্য সম্পদের অবচয়কে সঠিকভাবে হিসাবের মধ্যে আনা প্রয়োজন। যদি অবচয় যথাযথভাবে গণনা করা হয়, তবে স্যাটেলাইটটি লোকসানে রয়েছে বলেই প্রতীয়মান হবে। স্যাটেলাইট প্রকল্পের সফলতা নিশ্চিত করতে এবং ভবিষ্যতে লাভজনক হিসেবে পরিচালিত হতে হলে বিএসসিএলকে সঠিক ব্যবসায়িক কৌশল গ্রহণ করতে হবে।

আরও পড়তে পারেন