বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ১১টি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব তৈরির কাজকে ঘিরে নতুন সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।
এ কমিশনগুলো আগামী জানুয়ারির মধ্যে সংস্কার প্রস্তাব জমা দেওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন মহলে এই প্রস্তাব ফাঁস হওয়া এবং বিতর্ক শুরু হওয়ায় সংস্কার প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জনপ্রশাসন সংস্কারে অসন্তোষ
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের খসড়া প্রস্তাব ইতিমধ্যে প্রশাসনের ভেতরে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বাসা) এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে কমিশনপ্রধান ড. আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর অপসারণ দাবি করেছে।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এবং রাজনৈতিক পরিচয় যাচাইয়ের বিষয়ে পুরনো নীতিমালা অব্যাহত থাকায় কমিশনের সুপারিশকে অনেকেই ‘বৈষম্যমূলক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডার থেকে আলাদা করার প্রস্তাব নিয়ে সংশ্লিষ্ট ক্যাডার সংগঠনগুলোও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
অনেকে বলছেন, এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে বিসিএস কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে, যা সরকারি চাকরির অভ্যন্তরে নতুন জটিলতা তৈরি করতে পারে।
সংবিধান সংস্কারে জটিলতা
সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাজও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
এ কমিশন সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো পরিবর্তনের প্রস্তাব করছে, যার মধ্যে আছে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিত করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চালুর মতো বিষয়।
বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী সংবিধান পরিবর্তনের জন্য সংসদের বাইরের প্রক্রিয়া মেনে নিতে নারাজ।
বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে চাইলে বড় ধরনের রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হবে।
এদিকে গণপরিষদ গঠন করে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবও এসেছে, তবে এটি কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে দ্বন্দ্ব
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য একাধিক প্রস্তাব প্রস্তুত করছে।
ইভিএম পদ্ধতি বাতিল, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বন্ধের মতো সুপারিশ করছে এই কমিশন।
তবে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের পুরনো প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখায় এই কমিশনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সরকার ইতিমধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে, যা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন ইসি গঠনের প্রক্রিয়ায় সংস্কার কমিশনের সুপারিশ উপেক্ষিত হয়েছে, যা সংস্কার প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করতে পারে।
বিচার বিভাগ ও পুলিশ সংস্কারে বড় প্রস্তাব
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে।
তারা আদালতের মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দিচ্ছে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে প্রধান বিচারপতির নিয়োগে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব কমানোর বিষয়েও প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, পুলিশ সংস্কার কমিশন দেড়শ বছরের পুরনো পুলিশ আইনে পরিবর্তনের কথা বলছে।
তারা জবাবদিহি এবং পেশাদারি দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি পুলিশি অপরাধ প্রতিরোধে নতুন নীতিমালা তৈরির প্রস্তাব করেছে।
বিতর্কিত প্রক্রিয়া ও বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব জমা দেওয়ার আগেই বিভিন্ন তথ্য ফাঁস হওয়া এবং পুরনো প্রক্রিয়ায় নিয়োগ ও নীতিমালা অব্যাহত রাখা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সংস্কারের প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি করা।
সরকার যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সরাসরি প্রস্তাব বাস্তবায়ন শুরু করে, তবে তা আরও বড় সংকটের জন্ম দিতে পারে।