বাংলাদেশের দুই শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে বিক্ষোভের ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে প্রচারিত অভিযোগগুলোর ভিত্তিতে পত্রিকাগুলোর বিরুদ্ধে ‘ভারতপন্থী’ ও ‘দেশবিরোধী’ তকমা দেওয়া হচ্ছে।
বিক্ষোভকারীরা দাবি তুলেছেন এই পত্রিকাগুলোর সম্পাদকদের পদত্যাগ ও বিচারের।
অবস্থানের অংশ হিসেবে বিক্ষোভকারীরা ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায় দুই পত্রিকার কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে।
এ ধরনের ঘটনা নিয়ে সাংবাদিক মহল, গণমাধ্যম সংগঠন এবং সরকারের পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
বিক্ষোভের সূত্রপাত এবং হামলার ঘটনা দেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
বিক্ষোভের সূচনা ও ধারাবাহিকতা
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের শুরু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন প্রচারণা থেকে।
‘ভারতীয় আগ্রাসন’-এর অভিযোগ তুলে একদল ব্যক্তি গত বৃহস্পতিবার কাওরান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে প্রথম অবস্থান নেয়।
পুলিশের হস্তক্ষেপে ওইদিনই বিক্ষোভকারীদের সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
পরদিন শুক্রবার ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় ডেইলি স্টারের প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।
সেখানে বিক্ষোভকারীরা ‘জিয়াফত’ ও ‘জোড়া গরু জবেহ’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
বিক্ষোভকারীদের দাবি, এসব প্রতীকী কর্মসূচির মাধ্যমে পত্রিকাগুলোর ‘ভারতপন্থী অবস্থান’-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে।
শনিবারও দুই পত্রিকার কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভকারীরা উপস্থিত থাকলেও কার্যক্রম ছিল সীমিত।
রোববার বিক্ষোভ আরও তীব্র আকার ধারণ করে, যখন প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে গরু জবাই ও রান্নার আয়োজন করা হয়।
এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে।
এই সংঘর্ষে উভয়পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
রাতের দিকে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও পরের দিন দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
আক্রমণ ও হামলার ঘটনা
সোমবার, বিক্ষোভের সময় রাজশাহীতে প্রথম আলো জেলা কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটে।
‘আলেম ওলামা ও তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে পরিচালিত একটি মিছিল থেকে অফিসের ভেতরে প্রবেশ করে ভাঙচুর চালানো হয়।
বগুড়ায় প্রথম আলোর কার্যালয়ে ইট-পাটকেল ছোড়া হয় এবং সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলা হয়।
চট্টগ্রাম, বরিশাল ও মাদারীপুরসহ আরও কয়েকটি জেলায় বিক্ষোভ হলেও সেখানে তেমন কোনো বড় হামলার ঘটনা ঘটেনি।
হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি তাদের কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ ও দাবি
বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ তুলেছেন, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার ‘দিল্লির দাসত্ব’ করে এবং দেশের গণতন্ত্র ও ইসলাম ধর্মের ক্ষতি করেছে।
তাদের ভাষ্যমতে, পত্রিকাগুলো ২০০৭ সালের এক-এগারো পরিস্থিতি তৈরি করতে ভূমিকা রেখেছে।
সম্পাদকদের বিরুদ্ধে ‘প্রোপাগান্ডা’ ছড়ানোর অভিযোগ এনে তারা পদত্যাগ এবং আইনি বিচারের দাবি করেছেন।
কর্মসূচির শুরুর দিকে পত্রিকা দুটি বন্ধের দাবিও তোলা হয়েছিল।
তবে পরে এই দাবি থেকে সরে এসে ‘সম্পাদকদের পদত্যাগ ও ক্ষমা চাওয়ার’ দাবি করা হয়।
একজন বিক্ষোভকারী বলেছেন, “যত অন্যায় কাজ করেছে, সেটা স্বীকার করে সম্পাদকদের জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।”
বিক্ষোভকারীদের হুঁশিয়ারি, তাদের দাবি না মানলে আরও বড় ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের প্রতিক্রিয়া
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার বিক্ষোভকারীদের অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন বলে আখ্যা দিয়েছে।
দৈনিক প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেছেন, বিক্ষোভকারীদের অভিযোগে কোনো প্রমাণ নেই।
তিনি জানিয়েছেন, তাদের পত্রিকা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করে এবং সবসময় বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করে।
“আমাদের কোনো রিপোর্ট বা সম্পাদকীয় নীতিমালায় এ ধরনের অভিযোগ সমর্থন করে এমন কিছু নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এটাও বলা হয়েছে যে, তারা সমালোচনা গ্রহণে প্রস্তুত, কিন্তু সেটি হতে হবে তথ্যভিত্তিক।
অন্যদিকে, ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেছেন, বিক্ষোভকারীরা তাদের অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি।
“তারা যদি কোনো প্রতিবেদন বা কলাম দেখাতে পারে, আমরা সেটা নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত,” বলেন তিনি।
পত্রিকা দু’টির দাবি, এই অভিযোগগুলো আসলে সংবাদমাধ্যমের ওপর চাপ সৃষ্টি করার একটি প্রচেষ্টা।
তারা মনে করছে, এভাবে বিক্ষোভের মাধ্যমে সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সাংবাদিক ও কর্মীদের মধ্যে এই ঘটনার কারণে নিরাপত্তা ও মানসিক চাপ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
তবে পত্রিকা দুটি জানিয়েছে, তারা সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় সতর্ক রয়েছে।
বিক্ষোভের পেছনে ‘পরিকল্পনা’
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষ মনে করছে, বিক্ষোভটি পূর্বপরিকল্পিত এবং এর পেছনে কোনো গোষ্ঠীর সংগঠন রয়েছে।
সাজ্জাদ শরিফ বলেন, “কেউ না কেউ নিশ্চয়ই এটি সংগঠিত করছে। না হলে প্রতিদিন এত লোক এসে বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছে কীভাবে?”
তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো প্রচারণা এবং এর সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের বিক্ষোভের মধ্যে সম্পর্ক থাকার বিষয়টি ইঙ্গিত করেন।
মাহফুজ আনামও মনে করেন, বিক্ষোভকারীদের কার্যক্রম এবং তাদের বক্তব্য পরিকল্পিতভাবে সমন্বিত।
তবে পত্রিকা দুটি নিশ্চিত নয় যে এই বিক্ষোভের পেছনে রাজনৈতিক বা অন্য কোনো প্রভাব রয়েছে কি না।
“যা হচ্ছে, সেটা একক কোনো ঘটনার ফল নয়। এটা দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হওয়া একটি পরিস্থিতির বহিঃপ্রকাশ,” বলেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক।
এ ধরনের কার্যক্রম যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে তুলছে, তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।
গণমাধ্যম সংগঠনগুলোর নিন্দা ও উদ্বেগ
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ওপর হামলা এবং তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ নিয়ে নিন্দা জানিয়েছে গণমাধ্যমের মালিক ও সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো।
‘নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (নোয়াব) এই ঘটনাকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর চরম আঘাত হিসেবে উল্লেখ করেছে।
নোয়াব এক বিবৃতিতে বলেছে, “সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আঘাত দেশের গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের অধিকারের জন্য হুমকি।”
সংগঠনটি শান্তিপূর্ণ ও গঠনমূলক উপায়ে মত প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছে।
“কোনো পত্রিকার সংবাদের বিষয়ে আপত্তি থাকলে সেটি লেখালেখির মাধ্যমে তুলে ধরাই সঠিক পথ,” বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিক্ষোভকারীদের সহিংসতার প্রতি ইঙ্গিত করে নোয়াব বলেছে, এ ধরনের কর্মসূচি গণমাধ্যমের পরিবেশ ব্যাহত করছে।
তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, হামলার ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার।
সাংবাদিকদের জাতীয় সংগঠনগুলোও এই ঘটনাকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও পদক্ষেপ
সরকারও এ ধরনের বিক্ষোভ ও সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, গণমাধ্যম কার্যালয়ে হামলা বা চাপ প্রয়োগ কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না।
তিনি জানিয়েছেন, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
“আমরা কারো মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দিই না। কিন্তু তা যেন সহিংসতায় রূপ না নেয়,” বলেন তিনি।
নাহিদ ইসলাম পত্রিকা বন্ধের দাবির বিষয়ে বলেন, “এ ধরনের দাবি অযৌক্তিক এবং সংবিধানের বিরোধী।”
তিনি বিক্ষোভকারীদের প্রতি আহ্বান জানান, শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করতে।
সরকার ইতিমধ্যে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পত্রিকা কার্যালয়ের নিরাপত্তা জোরদার করেছে।
ঢাকার তেজগাঁও থানার ওসি মোবারক হোসেন বলেন, “পুলিশ ও সেনাসদস্য মোতায়েন করে আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছি।”
বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
সরকারের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, এখনো কাউকে আটক করা যায়নি।